ফুলেল শুভেচ্ছা : ইসলাম কী বলে?


মুফতি মুহাম্মদ সাদ কাসেমি ৷৷

মুমিন যখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোনো উচ্চাসন বা দুনিয়াবি পদমর্যাদা লাভ করে, তখন সে পদভারে চিন্তিত ও পেরেশান হওয়ার কথা; খুশি হওয়া বা আত্মপ্রসাদ লাভ করার কথা নয়। কিন্তু সে যদি এ উপলক্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় করে, শুভেচ্ছা বাক্য বা ফুলের তোড়া গ্ৰহণ করে এবং খুশি প্রকাশ করে, তাহলে সে প্রকারান্তরে উচ্চবিলাসী, পদমর্যাদা লোভী প্রমাণিত হবে। ইসলামে এমন ব্যক্তি দায়িত্ব ও পদ পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তেমনিভাবে ইসলামে কোনো পদে নির্বাচিত ব্যক্তিকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা, ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করা, তাঁকে নিয়ে শোডাউন বা শোভাযাত্রা করার প্রথা নেই। এগুলো ইসলামি স্বকীয়তা বিরোধী, অপসংস্কৃতি। কোনো ইসলামী দলের শায়ানে-শান নয় এই অপসংস্কৃতি আমদানি করা এবং চর্চা করা ।

যুগে যুগে শুভেচ্ছা বিনিময় প্রথা
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও কোনো পদ-প্রত্যাশী ব্যক্তিকে দায়িত্ব ও পদ দিতেন না। আবার যাকে দায়িত্ব ও পদ দিয়েছেন, তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতেন না। সাহাবায়ে কেরামও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সাহাবিকে আমির, অলি বা সেনাপতি নিযুক্ত করলে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন না। কেউ তাঁদেরকে মোবারকবাদ বা তাহনিয়া পেশ করতেন না। সাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী যুগের সালফে সালেহিনের মাঝেও এর প্রচলন ছিলো না। 

তাই বলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কোনো উপলক্ষ্যেই যে মোবারকবাদ, তাহনিয়া বা শুভেচ্ছা বিনিময় করেননি, এমনটি নয়। তাঁরা অনেক দীনি উপলক্ষে বা নেয়ামত লাভের পর পরষ্পরকে তাহনিয়া পেশ করতেন। হাদিসে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কোনো সাহাবি ইমারত ও খেলাফত লাভ অথবা অলি হওয়ার পর অন্যান্য সাহাবিগণ তাঁকে মোবারকবাদ বা তাহনিয়া পেশ করেছেন, এমন নজির হাদিসে পাওয়া যায় না।

শুভেচ্ছা বিনিময়ের বিধান
ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহিমাহুল্লাহ (৮৪৯–৯১১ হি.) যে সমস্ত ইসলামি উপলক্ষে তাহনিয়া আদান-প্রদান হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, সে সমস্ত উপলক্ষ ও তাহনিয়ার বাক্যসহ একটি কিতাব রচনা করেছেন। যার নাম—উসুলুল আমানি বি উসুলিত তাহানি (وصول الأماني بأصول التهاني)। এই কিতাবেও ইসলামি রাষ্ট্রের বা সমাজের কোনো উচ্চপদ লাভের কারণে কাউকে তাহনিয়া বা শুভেচ্ছা জানানো হতো বলে কোনো অধ্যায় উল্লেখ করেননি ।

তবে দীনি ও পরলৌকিক মর্যাদা পাওয়া উপলক্ষে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম পরষ্পরকে তাহনিয়া বা শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন—
হুদাইবিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আয়াত নাজিল হলো। তিনি বললেন, ‘আমার ওপর এমন একটি আয়াত নাজিল হয়েছে, যা জমিনের সকল বস্তু থেকে আমার কাছে প্রিয়।’ এরপর আয়াতটি তেলাওয়াত করলে সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে অভিনন্দন।’
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যখন সুরা কাউসার নাজিল হলো, তখন উসামা বিন জায়েদ (রা.) ও তাঁর স্ত্রী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাউজে কাউসার প্রাপ্তি উপলক্ষে তাহনিয়া বা শুভেচ্ছা জানানোর জন্য এলেন। উসামা বিন জায়েদ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনার কাছে এসে আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই।’
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আলী (রা.)-কে বললেন, ‘আমি যার বন্ধু হবো, আলীও তাঁর বন্ধু হবে।’ তখন তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিতাবুল্লার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আয়াত কোনটি?’ তিনি সঠিক জবাব দিলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মোবারকবাদ ও তাহনিয়া জানান।
হজরত কাব বিন মালেক (রা.)-এর তওবা কবুল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে দলে দলে এসে তাহনিয়া পেশ করেন। এমনকি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁকে মোবারকবাদ দেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হজ ফেরত হাজিদেরকে এ বলে তাহনিয়া ও শুভেচ্ছা জানাতেন, ‘আল্লাহ আপনার কোরবানি কবুল করুন এবং আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।’
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ থেকে ফিরে এলে সাহাবায়ে কেরাম ও হজরত আয়েশা (রা.) তাঁকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান।
রমজান মাসের আগমন, ঈদ, বিয়ে ও সন্তানের জন্ম, ইত্যাদি দীনি উপলক্ষে পরষ্পরকে তাহনিয়া পেশ করা, শুভেচ্ছা জানানো হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সাহাবায়ে কেরাম ঐ সমস্ত উপলক্ষে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন; অভিনন্দন জানাতেন।

প্রচলিত শুভেচ্ছা বিনিময় ও তার বিধান
ইসলামি রিয়াসতের ছোট-বড় কোনো দায়িত্ব বা পদ পাওয়ার পর তাঁকে শুভেচ্ছা বাক্য পেশ করা কিংবা ফুলের তোড়া বা মালা দিয়ে বরণ করা কিংবা শোডাউন বা শোভাযাত্রার মাধ্যমে ইস্তেকবাল করা—এসবের কোনোটাই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়; সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারাও সাবেত নয়। সালফে সালেহিনের তাআমুলও এমন ছিলো না। ইসলামি রাষ্ট্রের বা সংগঠনের উচ্চদস্থ হওয়া কোনো অধিকার অর্জন কিংবা নেয়ামত বা পুরস্কার লাভ নয়, কোনো আনন্দিত বা উৎফুল্ল হওয়ার বিষয় নয়, যার জন্য পদস্থ ব্যক্তিকে অভিনন্দিত করা যায়। বরং ইসলামি রাষ্ট্রের পদগুলি একেকটি  গুরুদায়িত্ব ও আমানত। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি দায়িত্বভারে এবং আমানতের খেয়ানতের ভয়ে বিচলিত ও চিন্তিত থাকবে। এটা আনন্দিত হওয়া বা অভিনন্দন পাওয়ার ক্ষেত্র নয়।

কাজেই ইসলামি সংগঠনের উচ্চাসনে আসীন ব্যক্তিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো, তাঁকে নিয়ে শোভাযাত্রা করা, ইত্যাদি ইত্যাদি গণতান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান, বিজাতীয় কালচার, অপসংস্কৃতি ও ইসলামি স্বকীয়তাবিরোধী। এ অপসংস্কৃতিকে উলামায়ে দেওবন্দের সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা চাই।

শিক্ষক : জামিয়াতুন নুর আল কাসেমিয়া, উত্তরা, ঢাকা 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ