জাগো প্রহরী : কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া খুব সহজ উল্লেখ করে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী বলেন – ‘সঠিকভাবে কাজ করলে ৬ মাসের মধ্যেই কওমি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব।’
এছাড়াও ‘কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার সকল ব্যবস্থা করতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করারও আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।’
বাংলাদেশে কওমী শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার সমস্যার সমাধান নিয়ে ‘মুসলিম ইয়ুথ সার্কেলে’র সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
রাজধানী ঢাকার ফকিরাপুলের হোটেল রাহমানিয়া রুফটপ রেষ্টুরেন্টে আজ বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) দিনব্যাপী এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
মাদরাসা দারুর রাশাদ এর প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহাম্মদ সালমান এর সভাপতিত্বে ও মুসলিম ইউথ সার্কেলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোহাম্মদ মনযূরুল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী।
তিনি তার বক্তব্যে বলেন – ‘কওমি মাদরাসার জন্য কওমি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার প্রয়োজন আছে। এটা নিয়েও আমি কাজ করবো ইনশাআল্লাহ। কওমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য কওমি ছাত্রদের যেতে আরও সহজ হবে। তবে কওমি বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়টি কিভাবে হতে পারে তা আমরা খুব দ্রুতই দেখবো। সে ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সম্মিলিত শিক্ষা সংস্থা আল হাইআতুল উলয়ার অধিনে অনুমোদন হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।’
তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন – মুসলিম ইয়ুথ সার্কেল যদি আল হাইআর অধিনে ওয়ার্কিং প্ল্যান করেন এ বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা দরকার হয় তাহলে আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।
তিনি আরও বলেন, কওমি মাদরাসার সার্টিফিকেট দিয়ে অবশ্যই সরকারি বেশকিছু জায়গায় চাকরি করা সম্ভব। বিশেষ করে দারুল আরকাম, সরকারি মসজিদ কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন পর্যায়ে দাওরায়ে হাদিসের সনদ দিয়ে চাকরি নেওয়া সম্ভব।
আবু রেজা নদভী বলেন – কওমি ছাত্রদের দেওবন্দ ও নদওয়ায় যাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমি কাজ করবো। প্রয়োজনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে আমরা সাক্ষাত করবো। এছাড়াও যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা নেবো। বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রনালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়সহ প্রতিটি সেক্টরে আমি এসব নিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দেবো।
তবে কওমি ছাত্রদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের অনুমতি নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ওয়ার্কিং প্লেসে কাজ করতে হবে। বক্তব্যে তিনি আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী রহ. এর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন আল্লামা শাহ্ শফী রহ বেঁচে থাকলে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় কওমি ছাত্রদের যাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন হয়ে যেত। তবে আপনারা এ বিষয়টি চাইলে খুব দ্রুতই হয়ে যাবে।
সেমিনারে প্রধান আলোচক ছিলেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ। তিনি তার বক্তব্যে বলেন – আল হাইআতুল উলয়ার অধিনে যখন কওমি মাদরাসার সনদের মান দেয়া হয়েছে তখন আমি সে কমিটির মধ্যে ছিলাম। আমি অবশ্যই আমার জায়গা থেকে সার্বিক চেষ্টা করবো যেন বিষয়টি একটি গোছালো প্রক্রিয়ার মধ্যে আসে। এছাড়াও তিনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে কওমি শিক্ষার্থীদের কী কী বাধা রয়েছে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন।
একই সাথে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মান দেয়া নিয়ে তিনি বলেন – বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সদিচ্ছা ছিলো এবং তিনি মরহুম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী রহ. কে সর্বোচ্চ সম্মান দিতেন। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু কওমি মাদরাসার প্রতি সর্বোচ্চ আন্তরিক তাই বিষয়টি তিনি সর্বোচ্চ বিবেচনা করবেন বলেও জানান তিনি।
সেমিনারে বিশেষ ৬ টি দাবিসহ মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন মুসলিম ইয়ুথ সার্কেলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর। প্রবন্ধে সরকার, সংশ্লিষ্ট মহল এবং দেশবাসীর প্রতি ৬ টি দাবি ও আহবান তুলে ধরেন।
৬ দফা আহবানগুলো হলো –
১. কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা সহজ ও নিষ্কণ্টক করতে সরকারিভাবে কওমি সনদকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক।
২. কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথিবীর সকল দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিতে তাদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসা সহজলভ্য এবং সকল আইনি জটিলতা নিরসন করা হোক।
৩. ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিশর, কাতার, বাহরাইন, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের বিভিন্ন ইসলামিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ক্রেডিট ট্রান্সফারের প্রক্রিয়া সহজ ও সহযোগিতামূলক করা হোক।
৪. একইভাবে এসব দেশের ইসলামিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী আদান-প্রদান (Student exchange)-এর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
৫. বিভিন্ন দেশের ইসলামিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রদত্ত স্কলারশিপ (বৃত্তি) গ্রহণের সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
৬. সরকারিভাবে কওমি সনদের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বিসিএস, পিএইচডি ও উচ্চতর গবেষণার সুযোগ করে দেওয়া হোক।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুসলিম ইয়ুথ সার্কেলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুহাম্মদ বদরুজ্জামান। আয়োজকদের মধ্যে ব্যবস্থাপনার সার্বিক ছিলেন মুহাম্মদ এহসান সিরাজ, হাছিব আর রহমান, নাজমুল ইসলাম কাসিমী ও রোকন রাইয়ান।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত কওমী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহীদের নিয়ে বিশেষ এ সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে প্রায় দেড়শ কওমি শিক্ষার্থী ও দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনেক কওমি শিক্ষকগণ উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন বেফাকুল মাদারিসিলি আরাবিয়া বাংলাদেশ এর সহ-সভাপতি মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু।
তিনি তার বক্তব্যে বলেন – আজকের এ উদ্যোগটি অবশ্যই অত্যন্ত সুন্দর একটি আয়োজন। আমাদের বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ ও কার্যক্রম অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে। আশা করি এ বিষয়ে আমরা বিশেষভাবে আরও বেশিভাবে চেষ্টা করবো যেন বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে কওমি ছাত্রদের সকল প্রতিবন্ধতা দূর হয়। এক্ষেত্রে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এবং আল হাইয়াতুল উলিয়া জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় দীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড এর মহাসচিব মুফতি মুহাম্মদ আলী।
তিনি তার বক্তব্যে মুসলিম ইয়ুথ সার্কেলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন – আমি আজকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কওমী শিক্ষার্থীদের দরদ ও মনের ব্যাথা দেখেছি। আমি মনে করি মনের দুঃখ ব্যাথা থাকলে যে কোন সমস্যার দ্রুত সমাধান হয়। আমি আশাবাদী আজকের এ সেমিনার থেকে এ সমস্যার সমাধান হবে। সেমিনারে যারা উপস্থিত আছেন তারা এ সমস্যার সমাধানের উপযুক্ত ব্যক্তি। আমরা আশা করি কওমি মাদরাসার ছাত্রদের স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বিদেশে বিশেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দে যাওয়ার সামগ্রিক ব্যবস্থা আমরা করবো। কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডগুলো এ বিষয়ে জোর ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
এছাড়াও বক্তারা সকলেই দেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা উচিত বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে সরকারের সামগ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী বলে মনে করেন তারা। সেমিনারে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে কওমী শিক্ষার্থীরা কি কি সমস্যার মুখোমুখি হন তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন – দাতব্য সংস্থা মারকাযুল ইসলামির চেয়ারম্যান মাওলানা হামজা ইসলাম, বিশিষ্ট ইসলামি আলোচক শায়খ ড. আহমদ উল্লাহ। স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ এর সমন্বয়ক অধ্যক্ষ সৈয়দ রেজওয়ান আহমদ, আহছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম এর সহকারী অধ্যাপক শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ির দাওয়া বিভাগের মুশরিফ মাওলানা আবু নোমান আল-মাদানী, ইসলামিক ল রিসার্চ অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার এর নির্বাহী পরিচালক শহীদুল ইসলাম, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের পরিচালক ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, সাইফুরসের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর সাইফুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর মুহাদ্দিস মুফতি ওয়ালিয়ুর রহমান খান, দ্বীনিয়াত বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মুফতী সালমান আহমদ প্রমূখ।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী, সৌদি আরবে উচ্চশিক্ষা, মো. ওমর ফারুক ইবরাহিমী, দারুল উলুম করাচি ও দরুল উলুম দেওবন্দে উচ্চশিক্ষা। মুহাম্মাদ হাস্সান আরিফ, বাইরাইনে উচ্চশিক্ষা, ড. রুহুল আমিন রব্বানি, সহকারী পরিচালক ইসলামিক ল রিসার্চ সেন্টার, মালয়েশিয়ায় উচ্চাশিক্ষা, মাওলানা কাওসার জামিল, মাওলানা জুবায়ের গনী, মাওলানা আবদুল কাইয়ুম প্রমূখ।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ :
আসসালামু আলাইকুম। সম্মানিত সুধী, অনুষ্ঠানের সভাপতি, প্রধান অতিথি, প্রধান আলোচক, বিশেষ অতিথি এবং উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানাই। আজকের এই ‘কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ।
সম্মানিত উপস্থিতি, বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক এবং কওমি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিফহাল ব্যক্তি হিসেবে আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে, কওমি শিক্ষাধারা এ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাধারা। সুদীর্ঘকাল ধরে এ শিক্ষাধারা বাংলা অঞ্চলের মানুষকে যেমন ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত করে আসছে; তেমনি স্বাধীনতা সুরক্ষা, উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন, সমাজ সংস্কার, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বৈষম্যহীন সমাজগঠন, অসাম্প্রদায়িক জাতি বিনির্মাণে কওমি মাদরাসার অবদান অনস্বীকার্য্।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সুপ্রাচীন এ শিক্ষাধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন অসংখ্য আলেম, বুজুর্গ, সুফি-দরবেশ, পীর-মুর্শিদ ও ইসলামপ্রিয় মানুষ। তাদের অনেকেই ছিলেন এ মাটির সন্তান, আবার অনেক দাঈ ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষা প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে আরব, পারস্য, ইয়েমেন, তুরস্ক, আফগানিস্তান, বোখারা-সমরকন্দ থেকে আগমন করেছিলেন এ বঙ্গভূমিতে। শুধু তাই নয়, বঙ্গ অঞ্চলের অসংখ্য বিদ্যার্থীও ইসলামি শিক্ষার্জনের নিমিত্তে সফর করেছেন আরব, বাগদাদ, হিন্দুস্তান এবং দূরপ্রাচ্যের অনেক দেশে।
আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে খুব সহজেই নজরে পড়বে সাহাবি, তাবেয়ি, হাদিস সংগ্রাহক আলেম, ফিকহের ইমাম, তাসাওউফের সুফি, সাহিত্যের কবি-শায়ের, চিকিৎসা ও দর্শনের জ্ঞান-অন্বেষী শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অন্বেষণে পাড়ি দিয়েছেন শত সহস্র মাইল। এক শহর থেকে চলে গেছেন আরেক শহরে, এক দেশ থেকে পাড়ি জমিয়েছেন আরেক দেশে। অনেক মহান ব্যক্তি দেশ-বিদেশে জ্ঞান অন্বেষণেই পার করেছেন তার সমগ্র জীবন। সীমানাহীন ভূখণ্ডে অবাধ যাতায়াত সুবিধার কারণে ইলম ও জ্ঞানের পরিধি ছিল ব্যাপক এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থী ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও পণ্ডিতের সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনের সর্বোচ্চ সুযোগ পেতেন।
আজ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মানচিত্রভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ফলে পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত জ্ঞানার্জনের অবাধ সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। বিশেষত বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ একেবারেই সীমিত ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। যদিও প্রতিবছর অল্পসংখ্যক কওমি শিক্ষার্থী সৌদি আরব, ভারত, মিশর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুযোগ না-থাকা, গতানুগতিক শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে সামঞ্জস্য না-থাকা এবং নানাবিধ সমস্যার কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কওমি শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ ভারতের উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত প্রাচীন ও সুবিদিত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ। বাংলাদেশের অসংখ্য কওমি শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে তারা কওমি শিক্ষাধারার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপনী সনদ অর্জন করবেন; কিন্তু ভিসা ও আইনি জটিলতা, মিডিয়ার অপপ্রচার এবং সহজলভ্য উপায়ে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তির সুযোগ না থাকায় তাদের স্বপ্ন অঙ্কুরেই মারা যায়।
১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতেন। দেশভাগ ও পাক-ভারত যুদ্ধ, এমনকি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও এ সুযোগ উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে হঠাৎ করেই ভারত সরকার বাংলাদেশি কওমি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেয়।
একই কথা বলতে হয় ভারতের উত্তরপ্রদেশের লখনৌতে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা ও উত্তরপ্রদেশের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়সহ ভারতের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের ব্যাপারেও। তেমনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্টুডেন্ট ভিসা না থাকার কারণে কওমি শিক্ষার্থীরা পাকিস্তানের জামেয়া দারুল উলুম করাচি, জামেয়া ইসলামিয়া বিনৌরি টাউন, জামেয়া রশিদিয়াসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।
এতসব প্রতিবন্ধকতার পরও একদল অদম্য শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জনের প্রাণান্ত নেশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা উপায়ে ভারতে পড়তে যান। তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে ধন্য হন, আবার অনেকেই শিকার হন গ্রেফতারি, জেল-জুলুমসহ নানা প্রকার রাষ্ট্রীয় হয়রানির। অথচ কওমি-শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই জানেন, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর দেওবন্দ-নদওয়ার সমাপনী পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে দাওরায়ে হাদিসের সনদ অর্জন করে থাকেন। ভারতের মাদরাসাগুলো তাই সবসময় বাংলাদেশি কওমি শিক্ষার্থীদের সাদরে বরণ করতে উৎসাহী।
সম্মানিত সুধী, আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, সৌদি আরবের মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কায় অবস্থিত উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কাতারের রাজধানীয় দোহায় অবস্থিত কাতার বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন দেখে এ দেশের হাজারও কওমি শিক্ষার্থী। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ইসলামি জ্ঞানের আধার সুপ্রাচীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন যেন স্বপ্নই রয়ে যাচ্ছে কওমি শিক্ষার্থীদের মনে।
একটা সময় পর্যন্ত আরবের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কওমি মাদরাসার সনদ ও কওমি আলেমদের সত্যায়নের ভিত্তিতে কওমি শিক্ষার্থীদের ভর্তি সহজসাধ্য ছিল। বর্তমানে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আরবের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে কওমি শিক্ষার্থীদের এখন আলিয়া মাদরাসা থেকে দাখিল-আলিমের সনদের প্রয়োজন হয়। এ কারণে অনন্যোপায় হয়ে কওমি শিক্ষার্থীদের বিরাট একটি অংশ আলিয়া মাদরাসায় পরীক্ষার দিকে ঝুঁকছে। যা কওমি মাদরাসার জন্য যেমন হুমকি স্বরূপ, তেমনি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায়ও ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
আরবের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদিও কওমি সনদ গ্রহণ করে থাকে কিন্তু দাওরা পড়ে সেখানে গিয়ে তারা এইচএসসির মানও পায় না। আবার নতুন করে তাদের চার বছরের অনার্স পড়তে হয়, এরপর মাস্টার্স ও উচ্চতর সনদ গ্রহণে ব্রতী হতে হয়। অথচ আপনারা সকলেই জানেন, কওমি সনদে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা করা হয়েছে।
আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কওমি সনদের মাধ্যমে আরবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা সমাপন শেষে যখন এসব শিক্ষার্থী দেশে আসেন তখন তাদের মাস্টার্স বা পিএইচডির সনদকে সরকারিভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। তবু অতীতে যেমন কওমি শিক্ষার্থীরা আরবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে তাক-লাগানো ফলাফল করেছেন তেমনি বর্তমানেও শত শত কওমি শিক্ষার্থী বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করে উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের নাম। আমরাও চাই, কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক এবং বৈধভাবে পৃথিবীর সকল দেশে জ্ঞানার্জনের রাজতোরণ তাদের জন্য উন্মুক্ত হোক।
সম্মানিত সুধী, আমাদের আজকেই এই সেমিনারের মাধ্যমে আমরা সরকার, সংশ্লিষ্ট মহল এবং দেশবাসীর প্রতি আমাদের আহ্বান তুলে ধরছি:
১. কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা সহজ ও নিষ্কণ্টক করতে সরকারিভাবে কওমি সনদকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক।
২. কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথিবীর সকল দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিতে তাদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসা সহজলভ্য এবং সকল আইনি জটিলতা নিরসন করা হোক।
৩. ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিশর, কাতার, বাহরাইন, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের বিভিন্ন ইসলামিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ক্রেডিট ট্রান্সফারের প্রক্রিয়া সহজ ও সহযোগিতামূলক করা হোক।
৪. একইভাবে এসব দেশের ইসলামিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী আদান-প্রদান (Student exchange)-এর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
৫. বিভিন্ন দেশের ইসলামিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রদত্ত স্কলারশিপ (বৃত্তি) গ্রহণের সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
৬. সরকারিভাবে কওমি সনদের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের বিসিএস, পিএইচডি ও উচ্চতর গবেষণার সুযোগ করে দেওয়া হোক।
সম্মানিত উপস্থিতি, উচ্চশিক্ষার জন্য এদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরাবরই বিশ্বের যেকোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে পড়তে যেতে পারছে। বরঞ্চ সরকারিভাবে কিংবা বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগে ছাত্রদের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার জন্য সারা পৃথিবী যখন নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনার ঘোষণা দিচ্ছে তখন আমাদের দেশের সরকার সুপ্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। কওমি মাদরাসা ও কওমি শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের এমন বৈষম্যমূলক আচরণ কাম্য নয়।
আমরা একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, এক দেশে কি দুই অর্থনীতি সম্ভব? গরিবের জন্য এক অর্থনীতি যদি থাকে এবং ধনীদের জন্য অন্য অর্থনীতি কেউ কি মেনে নেবে? একইভাবে, এক দেশে দুই শিক্ষানীতি হতে পারে না। কওমি শিক্ষার্থীদের এক ব্যবস্থা এবং দেশের অন্য সকল শিক্ষার্থীর জন্য অন্য ব্যবস্থা কেন থাকবে? একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকদের মধ্যে এমন বৈষম্য দেশের সংবিধান বিরোধী এবং আন্তর্জাতিকভাবেও অগ্রহণযোগ্য। আমরা আশা করব, কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সকল সমস্যা নিরসনে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং কওমি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের বৈশ্বিক ধারাকে অব্যাহত রাখবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন। ধন্যবাদ সবাইকে।
জাগো প্রহরী/এফজে
0 মন্তব্যসমূহ