আতাউল করীম মাকসুদ ৷৷
কোরবানী আরবী ‘কুরব’ শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ, নৈকট্য। মানে, কোরবানী করার দ্বারা মানুষ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করে। জাহেলী যুগেও মানুষ তাদের বিভিন্ন মুর্তির নামে পশু কোরবানী করত।
এ সময়েও অন্যান্য ধর্মালম্বীরা তাদের মুর্তির নামে সাময়িকভাবে বিভিন্ন জিনিস কোরবানী করে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ‘সুরায়ে কাওসারে’ রাসুলে কারীম সা.কে কোরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মুলত ইবরাহীম আ.কে আল্লাহ তাআলা স্বীয়পুত্র ইসমাইল আ.কে কোরবানী করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইবরাহীম আ. মক্কা শহরের নিকটে মিনা উপত্যকায় ছেলে ইসমাইল আ.কে কোরবানী করার জন্য নিয়ে যান। আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হয়ে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা প্রেরণ করেন। ইবরাহীম আ.সেই দুম্বা কোরবানী করেন।
আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মাদ সা. এর উম্মতের ওপর সে ধারবাহিকতা রেখে দিয়েছেন। ‘সুন্নাতু আবিকুম ইবরাহীম’ বলে নবী সা. সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। মদিনায় অবস্থানকালীন দশ বছরে রাসুলে কারীম সা. প্রত্যেক বছর কোরবানী করেছেন।
কোরবানীর ফজিলত:
হাদীস শরীফে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্নভাবে কোরবানীর ফজিলত ব্যক্ত করেছেন।
১. আয়শা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারীম সা. বলেন, কোরবানীর দিন আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম আমল পশু জবাই করা। রোজ কিয়ামতে পশুর পশম, শিং ও ক্ষুর মিজানের পাল্লায় ওজন করা হবে। কোরবানীর পশুর রক্ত জমিনে যাওয়ার আগেই আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেন। (ইবনে মাজাহ: হাদিস নং ৩১৬২। তিরমিজি: হাদিস নং ১৪৯৩। মুসতাদরাকে হাকেম: ২/ ৩৮৯।)
২. জায়দ ইবনে আরকাম রাদি. থেকে বর্ণিত একদি দীর্ঘ হাদিসে উল্লেখ আছে, রাসুলে কারীম সা. বলেন, কোরবানীর পশুর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা সওয়াব দান করেন। সাহাবায়ে কেরাম তখন পশুর শরীরের অবাঞ্ছিত পশমের কথা বলেন। রাসুল সা. বলেন, সেগুলোর বিনিময়েও আল্লাহ তাআলা সওয়াব দান করেন। (তিরমিজি: ১৪৯৩।)
৩. আবু সাইদ খুদরী রাদি. বলেন, একবার রাসুল সা. হজরত ফাতেমা রাদি.কে বলেন, নিজের কোরবানীর দৃশ্য দেখ, পশুর রক্তের প্রথম ফোটা মাটিতে পড়ার আগে আগেই আল্লাহ তাআলা তোমার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (মুসনাদে বাজজার: ১২০২।)
৪. হুসাইন ইবনে আলি রাদি. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন, আনন্দচিত্তে আগ্রহভরে কোরবানীর পশু জবাই করলে সেই পশু তাকে জাহান্নামে যাওয়া থেকে বাধা দিবে। (তাবরানী, আত তরাগীব ওয়াত তারহীব: ১৬৫১।)
কোরবানীর আরও ফজিলত
৫. কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার পর কোরবানী না করলে রাসুল সা. অত্যন্ত ধমক প্রদান করেছেন। রাসুল সা. বলেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানী করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহের পাশ দিয়েও না আসে। (মুসনাদে আহমাদ: ১৬/ ৪৪৬। মুসতাদরাকে হাকেম:১৭/ ৪২৪)
কোরবানীর সময়:
জিলহ্জ্ব মাসের তিন দিন কোরবানী করা যায়। ১০, ১১ ও ১২ই জিলহ্জ্ব। তবে প্রথম দিন করা উত্তম। ঈদের নামাযের আগে কোরবানী করা জায়েজ নয়। কেউ ঈদের নামাযের আগে কোরবানী করলে তাকে পুনরায় কোরবানী দিতে হবে।
কোরবানী কাদের ওপর ওয়াজিব:
যে মুসলমান, বুদ্ধিমান, বালেগ, মুকিম ব্যক্তির মালিকানায় সাড়ে ৫২ তোলা রুপা অথবা তার সমমুল্যের সম্পদ রয়েছে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের বাহিরে, তার ওপর কোরবানী করা ওয়াজিব। এমনকি সে সম্পদ স্বর্ণ, রোপা, অলংকার, ব্যবসায়িক সম্পদ, ঘরে থাকা প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসপত্র, নিজিরে অবস্থানের অতিরিক্ত বাসাও এ তালিকার অন্তর্ভূক্ত।
একটি কথা খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পদের ওপর এক বছর অতিক্রম হওয়া আবশ্যক নয়। শিশু সন্তান যদি কোনোভাবে এই পরিমান সম্পদের মালিক হয়ে যায়, তবুও তার ওপর কোরবানী করা ওয়াজিব নয়।
কোন প্রাণী দ্বারা কোরবানী করা বৈধ:
বকরী বা দুম্বা একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে (দ্বিতীয় কোনো অংশভদার নেওয়া যাবে না) কোরবানী করতে হয়। গরু, ষাড়, মহিষ, উট সাতজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানী দেওয়া যায়। বকরীর বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে। দুম্বা যদি দেখতে এমন হয় যে, এক বছরের মনে হয়, তাহলে কুরবানী করা বৈধ। গরু ও মহিষ কমপেক্ষে দু’বছরের হতে হবে। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। এর চেয়ে কমবয়সী পশু দ্বারা কোরবানী করা সঠিক নয়।
কোরবানী বিষয়ে জরুরি কয়েকটি মাসআলা:
১. একাধিক ব্যক্তি মিলে পশু কোরবানী করলে পাল্লা দ্বারা মেপে মেপে গোশত ভাগ করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করবে না।
২. কোরবানীর গোশত তিনভাগ করা উত্তম। একভাগ নিজের পরিবার পরিজনের জন্য, একভাগ আত্মীয়স্বজনের জন্য, একভাগ গরীব মিসকীনদের জন্য দান করে দেওয়া।
৩. কোরবানীর গোশত বিক্রি করা হারাম।
৪. কোরবানীর কাজে সহযোগী ব্যক্তিকে পারিশ্রমিক হিসেবে গোশত অথবা চামড়া দেওয়া জায়েজ নয়। অন্য কিছু দ্বারা পারিশ্রমিক দিতে হবে।
জাগো প্রহরী/গালিব
0 মন্তব্যসমূহ