শহিদ আনওয়ার শাহ ( র.) : একটি স্মৃতি ও ইতিহাস।



মাহমুদ আমান ৷৷

৫ই মে ২০১৩ ৷ শহিদ আনওয়ার শাহ (র.) ৷ একটি স্মৃতি । একটি ইতিহাস। দুপুরের পর থেকে দিগন্ত টেলিভিশন যেখান থেকে লাইভ দেখাচ্ছিলো, তার থেকে ১০/১৫ পিছনে অবস্থান করছিলাম আমি আর আব্দুল কাইয়ুম ভাই। আসর পর্যন্ত ওখানে বসে বড়দের নাসীহা শুনছিলাম। আসরের নামাজের আবার ভাষণ শুরু হলো। এরই মাঝে পল্টনের ওদিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ কানে আসতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরে রক্তাক্ত একটা লাশ নিয়ে কজন মানুষ পল্টন থেকে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো। স্টেজ থেকে লাশ আসার খবর মাইকে প্রচার করা হলো এবং সবাইকে খুব ধ্যানের সাথে উচ্চ আওয়াজে জিকিরের কথা বলা বলো। সবাই খুব জোরেশোরে অন্তর দিকে জিকির শুরু করলো। 
এর মাঝে খেয়াল করলাম যে, আনওয়ার শাহ ভাই  সামনের দিক থেকে পিছনের দিকে অর্থাৎ পল্টন অভিমুখে যাচ্ছে, আমি উঠে গিয়ে উনার হাত ধরে টান দিয়ে আমার পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 
: কই যান?
: পল্টনের ওদিকে।
: না, যেতে হবে না। এখানে বসেন।
উনি বসে গেলেন এবং সবার সাথে তাল মিলিয়ে জিকির শুরু করলেন।
বারবার লক্ষ্য করলামক্স উনি একটু পরপর দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে দেখেন আর সেদিকে চিলে যেতে চান, আমি তখন উনার হাত ধরে বসিয়ে দেই...

এভাবেই ওখানে থেকে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম। 

রাত তখন আনুমানিক সাড়ে ৭টা। মাগরিবের নামাজের কিচ্ছুক্ষণ পর থেকেই পল্টনের ওদিক থেকে বিকট আওয়াজে সাউন্ড গ্রেনেড ফুটানো হচ্ছে... আলোর ঝলকানিতে রাতের আধাঁরেও দানবাকৃতির আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলো স্পষ্ট চোখে ভেসে উঠছে। স্টেজ থেকে জোরে জোরে জিকিরের কথা বলা হচ্ছে, আমরা সুউচ্চ আওয়াজে জিকির করেই চলেছি...
এরি মাঝে পিছন দিক থেকে গ্রেনেডের আওয়াজ যেন আস্তে আস্তে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। পিছনের মানুষগুলো ভয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সামনে থেকে যতই বলা হচ্ছে বসেন, কেউ শুনছে না। শেষ পর্যন্ত পিছনের মানুষগুলো সামনের দিকে আগাতে শুরু করলো। বাধ্য হয়ে আমিও আমার সাথে থাকা আনওয়ার শাহ ভাই ও আব্দুল কাউয়ুম ভাই দাঁড়িয়ে গেলাম। স্রোতের তালে আমরা সামনের দিকে আগাতে লাগলাম। প্রচন্ড ভীর। একজনের বুকের সাথে আরেকজনের পিঠ লেগে আছে।

সকাল থেকে স্বেচ্ছাসেবকে ভুমিকা পালন করছিলাম। তাই হাতে ছিলো একটা আড়াই হাত লম্বা বাঁশ আর তার মাথায় জাতীয় পতাকা। পায়ে ছিলো কদিন আগে কেনা একজোড়া চামড়ার দামি জুতা। কোনোভাবে জুতা খুলে বাঁশের মাথায় ঢুকিয়ে নিলাম। কারণ, ইতিমধ্যে মানুষের ধাক্কায় অনেকেই জুতা হারিয়ে ফেলেছে। আমি এক হাত দিয়ে বাঁশ ধরলাম, অপর হাত আনওয়ার শাহ ভায়ের ভায়ের হাতের মাঝে ঢুকিয়ে শক্ত অবস্থান উনার হাত জড়িয়ে ধরলাম। পিছনে ছিলো আব্দুল কাইউম ভাই। খুব কষ্টে ফুটপাত দিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে যেতে লাগলাম। উনাকে বললাম!

:আনওয়ার শাহ ভাই! হাত ছাইড়েন না।
:আচ্ছা, শক্ত করে ধরে রাখেন।
এরপর আরো শক্ত করে উনার হাতকে নিজের বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।
অনেক কষ্টে শাপলা চত্বর মোড়ে এসে দাঁড়ালাম।
এখানে কিছুটা ভীড় কম। কিছুক্ষণ পরে দেখি কয়েকজন ধরাধরি করে এক ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে, চাপ খেয়ে তার একটা হাত উল্টে গেছে। আরেকজনকে দেখলাম। গ্রেনেড তার শরিরে লেগেছে, সেখান দিয়ে রক্ত ঝরছে। আরো বেশ কজন আহত ব্যক্তিকে দেখলাম।
এরি মাঝে আনওয়ার শাহ ভাই আমাকে বললেন! 
:মাহমুদ ভাই! আমাকে ছাড়েন! আমি একটু স্টেজের দিকে যাই
: না, ওদিকে যেতে হবে না। এখানেই থাকি৷ ওখানে নিরাপদ না।
উনি চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার উনি যাওয়ার জন্য জোরাজোরি শুরু করলেন। এবার আর আটকাতে পারলাম না। উনি যে তে শুরু করলেন। বল্লামঃ-
: মাদরাসায় যাবেন না?
: আপনারা চলে যান, আমি যাবো না।
তখন ভাবিনি যে, তার কথা সত্য হবে। 
সত্যি তিনি জীবিত ফিরে আসেননি। 
আমরা দুজন আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে কোনো সাথী ভাইকে না পেয়ে অনেক কষ্টে জীবনের রিক্স নিয়ে মাদরাসায় চলে আসলাম। তখন বাজে ৯টা।  এসে দেখি সাথীরা সবাই আগেই মাদরাসায় এসে উপস্থিত হয়ে গেছে। কল্পনাও করিনি যে, সবাই এভাবে আগেই চলে আসবে।
২/৪জন ছাড়া সবাই হাজির।

সাড়ে ৯টার সময় এক অজানা নাম্বার থেকে বড় হুজুরের নাম্বারে কল আসলো, ওপার থেমে বলছে যে, আনওয়ার শাহ নামে আপনার এক ছাত্র  শাপলা চত্বরে স্টেজের সামনে মৃত পড়ে আছে। ওকে এসে নিয়ে যান...!
হুজুর সাথে সাথে পড়ে উঠলেন..
ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন.....

জাগো প্রহরী/গালিব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ