করোনা ভাইরাসকালীন এই বন্দী পৃথিবীতে এখন আলোচনার বিষয়- সরকারি অনুদান। পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরনের যুক্তি তর্ক চলছে। কোয়ারেন্টাইনের এই নিরব নিস্তব্ধ সময়েও গরম হয়ে উঠছে পরিবেশ। অনুদান আনতে পেরে কিছু মানুষের উচ্ছাস দেখে অবাক লাগছে। আদর্শ বিকিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে জাগ্রত তরুণদের লেখায় আশাবাদিও হচ্ছি। কওমির মুখলিস আলেমদের হৃদয় ভাঙার আওয়াজে ভীতরটা কেপে উঠছে।
কওমি মাদরাসার নীতি আদর্শ বিরোধী এই কাজের বিপক্ষে কথা বলতে হবে। সহজ বাংলায় মূল হলো -আমাদের পক্ষে সরকারি অনুদান গ্রহণ করা সম্ভব না। কওমি মাদরাসার কিছু দায়বদ্ধতা আছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের এই অনুদান গ্রহণ অনেক ধরনের অকল্যাণের দুয়ার খুলে দিতে পারে। আমি জানি কিছু মানুষ এই অনুদানের পক্ষে আছেন, আমি তর্কে যেতে চাই না। কিছু পয়েন্টে ভাবনা বিনিময় করতে চাই।
১) কওমি মাদরাসা এখন রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। কওমি মাদরাসাকে সরকার হাতে রাখতে চায়। কওমিওয়ালাদের কীভাবে সরকারের অধিনস্ত করা যায়- এই চেষ্টায় কিছু মানুষ নিয়োজিত আছে। একটি অনুদান এসেছে। দরকার হলে আরও আসবে। সরকার কতগুলো প্রণোদনার ঘোষনা দিলো। সেগুলো খবর কি? সেগুলো প্রকৃত গরিবের হাতে গিয়েছে? যায়নি। চালতো সব চোররাই খেলো। কিন্তু মাদরাসায় অনুদান ঠিকই চলে এসেছে। এর কারণ কি? কারণ একটাই, হুজুরদের খাওয়াতে পারলেই তারা খুশি।
২) মনে রাখতে হবে, কওমি মাদরাসার মূল পরিচয় হলো, কওমি মাদরাসা জনসাধারণের সহযোগিতায় পরিচালিত। সরকারি অনুদানে নয়। সরকারের রশগোল্লা খাওয়ার জন্য কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এই নীতি আদর্শের সাথে আপোষ করার সুযোগ নেই। উসুলে হাশতেগানার প্রতি অন্ধ অনুসরণের দাবি করছি না। কওমি মাদরাসায় প্রয়োজনে সংস্কারও আসতে পারে, কিন্তু সরকারি অনুদানে অভ্যস্ত হলে কওমি মাদরাসার মূল পরিচয়ই আর বাকি থাকে না।
৩) অনেকে বলবেন- এটা বিশেষ পরিস্থিতি। প্রশ্ন করতে চাই কওমি মাদরাসায় আর্থিক সংকট কি নতুন কিছু? হ্যা, এখন অন্য যে কোন সময় থেকে প্রয়োজন অনেক বেশি। এখন যদি বিশেষ বিবেচনায় অনুদান গ্রহণ করা হয়, তাহলে ভবিষতে কারণে-অকারণে এধরনের দাবি উঠতে থাকবে। সারা দেশের মানুষই এখন কমবেশি সমস্যায় আছে। ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো প্রয়োজন হয়তো অনেক বেশি। তবুও ব্যক্তিগত স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া যায় না।
৪) কওমি মাদরাসা যখন সরকার থেকে অনুদান নিতে শুরু করবে তখন কোন মুখে সাধারণ মানুষের কাছে সহযোগিতা চাইবে? আস্তে আস্তে জনগনের সহযোগিতা কমতে থাকবে আর সরকারি সহযোগিতা বাড়তে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই মাদরাসাগুলোর উপর ধীরে ধীরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকবে। এভাবেই এক সময় কওমি মাদরাসাগুলো আপন স্বকীয়তা হারিয়ে পরাধীনতার শেকল পরতে বাধ্য হবে।
৫) আমরা এদেশের নাগরিক। আমরা সরকারকে টেক্স দেই। সরকারের পানি, বিদুৎ, গ্যাস করি। সাধারণ নাগরিক হিসেবে অন্য কেউ যে সহযোগীতা সরকার থেকে পায় আমাদের সেটা গ্রহণ করতে দ্বিধা নেই। তবে অসহায় কওমি মাদরাসা শিক্ষক হিসেবে সরকার আমাকে কেন অনুদান দিবে? অন্য একজন সাধারণ নাগরিককে সরকার কি এই অনুদান দিচ্ছে?
৬) দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ মাদরাসায় নানা ধরনের সহযোগিতা করে থাকেন। বিচ্ছিন্নভাবে এসব অনুদান আর আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে সকল কওমি মাদরাসার জন্য বরাদ্ধ এক কথা নয়। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে কেউ হজ্বে গিয়েছে বা অন্য কোন সুবিধা গ্রহণ করেছে। এসব বিচ্ছিন্ন বা ব্যক্তিগত কাজ সবার জন্য অনুদান গ্রহণ বৈধতার প্রমাণ হতে পারে না।
৭) সরকারি অনুদান কে কিভাবে বন্টন করবে? সম্মিলিতভাবে কওমি মাদরাসার অভিভাবক সংগঠনগুলো যেহেতু এ ধরনের অনুদান গ্রহণ করবে না। ফলে এখানে অনুদান বিতরণে নানা ধরনের ভুলত্রুটি হতে পারে, দুর্নীতিও হতে পারে। তখন পত্রিকায় শিরোনাম হবে- কওমি মাদরাসার ২০০ কোটি টাকা অনুদান কোথায় গেলো? হুজুরদের ভুল ধরার মতো মানুষের কিন্তু অভাব নেই।
৮) অনুদানের পরিমাণ নিয়ে কোন আপত্তি নেই। আট কোটির জায়গায় একশত কোটি হলেও কথা একই থাকবে। পরিমাণ নিয়ে ব্যঙ্গ হচ্ছে মূলত সরকারের বাজে সিদ্ধান্তটা ফুটিয়ে তুলতে। তবুও এটা না করাই ভালো। যারা এই অনুদান এনেছে তারা হয়তো তৎপর হবে সামনে কিভাবে মোটা অংকের অনুদান আনা যায়। এবং শন্কা হয়-এটা হয়তো প্রাথমিক অনুদান ছিল। সামনে আরও আসতে পারে।
৯) কেউ বলবেন সরকারি স্বীকৃতি হয়েছে, এসব এখন হবেই। আমি বলতে চাই, ভবিষতের এই শংকা আমার মনেও আছে, তাই বলে কি এখনই নাকে খত দিয়ে সরকারের কাছে যেতে হবে? আমার আপনার সন্তান ভবিষতে ভুল পথে যেতে পারে, তাই বলে কি আমি এখন হাল ছেড়ে দিতে হবে? সঠিক পথে রাখার সবোর্চ চেষ্টা তো আমাদের করে যেতে হবে। আমাদের দায়িত্ব তো শুধু এটুকুই।
১০) আমাদের একটা দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের মহলেই এটা শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা কওমি মাদরাসাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনয়ণ কর্মসূচির প্রধান সহযোগী। এদের বসবাস আবার উপর তলায়। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় তাদের কাজগুলো সরকারের পক্ষেই যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের বিপক্ষে থাকতেই তাদের ভালো লাগে। যে অনুদান এসেছে এর পিছনে তারাই হয়তো অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।
এসব কারণেই সরকারি অনুদান গ্রহণ করা যাবে না। আল্লাহর উপর ভরসা করে দ্বীনদার মানুষের সহায়তায় এতকাল হাজার হাজার কওমি মাদরাসাগুলো যেভাবে চলেছে, সামনের দিনগুলোতেও চলতে পারবে। সরকারি অনুদান অতীতে প্রয়োজন হয়নি, সামনেও হবে না। উম্মাহর বৃহৎতর স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মহান আল্লাহর মেহেরবানি ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে কওমি মাদরাসাগুলো এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে ৷ ইনশাআল্লাহ
লেখক : সহকারী সম্পাদক,রাহমানী পয়গাম ৷
জাগো প্রহরী/এফ আর
0 মন্তব্যসমূহ