বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি ১০দফা আবেদন : সৈয়দ শামছুল হুদা

সৈয়দ শামছুল হুদা ৷৷

দেশের ইসলামী রাজনীতি এবং মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত স্বার্থে আজ কিছু কথা বলবো। হয়তো এ কথাগুলো কারো কাছে ভালো লাগবে, হয়তো কারো কাছে ভালো লাগবে না। আমি এ কথাগুলোর কোন উত্তর কারো কাছ থেকে আশা করি না। আমি জানি, আমার এ কথাগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য আমার চেয়ে অনেক অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন হাজারো নয়, লাখো মানুষ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমি এ কথাগুলো বলবো শুধূ অনুভব করার জন্য। যদি ভালো মনে হয়, যদি প্রয়োজনীয় মনে হয়, তাহলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন। আর যদি ফালতু মনে হয়, তাহলে ফেসবুকের ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন।

আমি এ কথাগুলো বলবো, বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। আমি এ কথাগুলো বলবো, বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান শক্তি, তুরস্ককে সামনে রেখে। একে পার্টিকে সামনে রেখে। এরদোয়ানকে সামনে রেখে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর হাজার হাজার লেখক, গবেষক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছেন। আছেন তুরস্কেও। এ কথাগুলো এজন্য বলবো যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অনুপ্রেরণায় সারাবিশ্বে লাখ লাখ উদীয়মান নবীন/প্রবীণ কাজ করছে। মুসলিম বিশ্ব থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকায় তাদের লাখো লাখো অনুসারী, যারা অর্থ-বিত্তে সুপ্রতিষ্ঠিত, যোগ্যতা, মেধায় অগ্রগামী। তাদের বড় একটি স্বপ্ন এই যে, বাংলাদেশে তারা ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত দেখেতে চান। ইসলামী রাজনীতির বিজয় দেখতে চান। আমি এই প্রেক্ষাপটটাকে সামনে রেখেই কথা বলবো। তাদের আশা ও স্বপ্নপূরণে সামান্য কিছু পরামর্শ দিতেই আমার এ লেখা। আমি আবারও বলছি, আপনাদের চর্চিত মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতার তুলনায় আমার কোন তুলনা চলে না।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে, যে ধরণের সামাজিক এবং ধর্মীয় সমস্যা বিরাজমান সেই প্রেক্ষাপটে এসব ভাবনা যদি সামান্যও উপকারে আসে, তাহলেও নিজেকে ধন্য মনে করবো। আমি বিশ্বাস করি, আপনাদের মাঝে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, যারা জান-প্রাণ দিয়েই দ্বীনকে ভালোবাসেন। ইসলামকে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসেন। আর এ কাজের জন্য অনেক ত্যাগ ও কোরবানি দিয়েছেন। এদেশে স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি, প্রশাসন, শিল্প-সাহিত্য, গবেষণা, মিডিয়া, চিকিৎসাজগত সর্বত্র ইসলামকে ছড়িয়ে দিতে যারপর নাই চেষ্টা করেছেন।

প্রশ্ন হলো, তদুপরি কেন কাঙ্খিত সফলতা আসছে না। আপনাদের চোখে সমস্যা এক ধরণের। সাধারণ মানুষের চোখে সমস্যা এক ধরণের। আমি আমার চোখে যে সকল সমস্যাকে বড় করে দেখছি সে সবই এখানে উপস্থাপন করবো। আপনাদেরকে ভাবতে অনুরোধ করবো যে, যেভাবে বর্তমানে রাজনীতি চলছে, সে চলমান পথে কি আদৌ সফলতা আসার সম্ভাবনা আছে? আপনারা যাদেরকে প্রতিবন্ধক মনে করছেন সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো আসলেই কি বড় শত্রু? নাকি এগুলোর সাথেও সমঝোতা করা যায়। মিলে মিশে কাজ করা যায়।তা নিয়ে একটু ভাবনার খোরাক যোগানই আমার এ লেখার উদ্দেশ্য।

দশ দফা প্রস্তাবনা : 

০১। দলের নাম পরিবর্তন :

খুব সহজভাবেই কথাটা বলে ফেললাম। যদিও বিষয়টা এত সহজ নয়। তদুপরি আপনারা যদি তুরস্ক থেকে শিক্ষা নেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে, আসলে দলের নাম খুব বড় একটি ফ্যাক্টর নয়। সরকার থেকে চাপ এসেছে, এই দল চলবে না, ব্যাস, দলের নাম বদলে ফেলেছে। নতুন নামে তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলবো, যেহেতু বাংলাদেশে এই দলটিকে নিয়ে অতি রাজনীতি করার ফলে তরুন প্রজন্মের মনে এক ধরণের নেতিবাচক ধারণার বীজ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু ব্যাপক পরিসরে কাজ করার জন্য দলের নামটি প্রয়োজনে চ্যাঞ্জ করতে হয়, আশাকরি সেটা বিশেষভাবে বিবেচনা করবেন।

০২। নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসা :

জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বের ব্যাপারে এতবেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, যে কারণে সাবেক নেতৃত্বের অনেকে আল্লাহর ইচ্ছায় চলে গিয়েছেন এবং বাকী যারা যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর সাথে যে কোনভাবেই হোক জড়িয়ে গেছেন তাদেরকে সামনের কাতার থেকে সরিয়ে দিয়ে সেকেন্ড সারির নেতৃত্ব দিয়ে দলটিকে সাজাতে পারেন। এক্ষেত্রেও তুরস্ক মডেল অনুসরণ করতে পারেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট মেন্ডারিসকে ফাঁসি দেওয়ার পর একের পর এক দলকে ব্যান্ড করা হযেছে। নাজমুদ্দিন এরবাকানকে নিয়ে নানা খেলা তুর্কি আর্মি খেলেছে। তারপরও তারা হতোদ্যম হয়নি। নতুন নাম, নতুন নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছে। সর্বশেষ এরদোয়ানের নেতৃত্বে সফলতা এসেছে ও স্থায়ী হয়েছে। এই এরদোয়ানকে ৪ লাইনের একটি কবিতা পাঠের জন্য ইস্তাম্বুলের মেয়র থাকা অবস্থাযও তাকে বহিস্কার করেছে। জেলে ঢুকিয়েছে। এরদোয়ান কিন্তু পিছপা হয়নি। ধৈর্যহারা হয়নি। সুতরাং আপনারাও বাংলাদেশের মানুষের মন-মেজাজ, বাস্তবতা, একাত্তর, স্বাধীনতাযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধী ইস্যু ইত্যাদিকে সামনে রেখে নতুন করে নেতৃত্বকে ঢেলে সাজাতে পারেন।

০৩। আপত্তিগুলোর ব্যাপারে একটি সমাধানে আসা :

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম যে কয়েকজন ছিলেন তাদের থেকে কিছু কিছু আপত্তি উঠে এসেছে। যদি আপনারা সত্যিকার অর্থেই ইক্বামতে দ্বীনের স্বপ্ন দেখেন, যদি সত্যিকার অর্থেই কোন ব্যাক্তিকে খুব বড় করে না দেখেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠাই যদি হয় একান্ত চাওয়া, স্বপ্ন। তাহলে অনুরোধ করবো, সংগঠনের উজ্জল ভবিষ্যতের স্বার্থে আলেম-উলামাদের সাথে বসে কী কী বিষয় আছে যেগুলো সামান্য পরিমার্জনের দ্বারা বৃহত্তম স্বার্থ তথা দ্বীন কায়েমের পথে আরো অনেক বেশি মানুষকে পাশে টানা যায়, তার উদ্যোগ নেওয়া। মনে রাখতে হবে, মাওলানা মওদুদী রহ. একজন মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক বেশি লিখেছেন। গবেষণা করেছেন। এ কারণ তাঁর লেখার কোন কোন বিষয়ে আপত্তি থাকতেই পারে। যেহেতু তিনি নবীও না, রাসূলও না। উপরুন্ত তিনি একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন, সম্পাদক ছিলেন।লেখালেখিই যার ছিল পেশা। নেশা। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চডিগ্রী অর্জন করেননি। জনাব মাওলানা আব্বাস আলী খানের হাতে লেখা মাওলানা মওদুদী রহ. এর জীবনী থেকে জানতে পেরেছি যে, তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন। তিনি একজন গবেষক আলেম ছিলেন। সে হিসেবে গবেষণার কোন কোন সূত্র ধরে আলেমদের সাথে ভিন্নমত হতেই পারে। এছাড়া উনার সহকর্মী, যারা উনার আকর্ষণীয় লিখনী শক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে উনার সাথে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ, ও মাওলানা মনজুর নোমানী। কিছু বিষয়ে দর্শনগত, চিন্তাগত, ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে উনাদের সাথে মাওলানা মওদুদী রহ. সাথে ভিন্নমত হয়। এক পর্যায়ে উনারা দল ছেড়ে চলে যান।

আলেমদের নিকট উক্ত দু’জন মাওলানার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। সুতরাং তাদের বক্তব্য উলামায়ে কেরাম গ্রহণ করেন। এবং সেই থেকে বিরোধিতাও চলে আসছে। কী কী বিষয়ে সেই সময়ে উনারা আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন সেগুলো নিয়ে জবাবের পর জবাব না লিখে, বিতর্কের পর বিতর্ক তৈরি না করে কীভাবে একটি সমাধানমুলক পরিবেশ তৈরি করা যায় তা নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন। এতে করে আমি মনে করি মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ রয়েছে। জিদ ধরে রেখে কোন কাজের সমাধান আসবে না। কোনদিন সূরাহা হবে না। উত্তরের পর অনেক উত্তর দেওয়া যাবে। কিন্তু আলেমদের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাওয়া যাবে না।

০৪। ইতিহাসের পর্যালোচনা গুলোর ব্যাপারে সমাধানে আসা :

মাওলানা মওদুদী রহ. এর খেলাফত ও মুলকিয়ত নিয়ে অনেক বেশি বিতর্ক হয়েছে। এবং ইতিহাসের প্রকৃত অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইসলামের অস্তিত্বেই আঘাতের পরিবেশের তৈরী করেছে। কথার কথা যদি বলি, মনে করেন, আপনার বাবা খুব ভালো মানুষ। কিন্তু আপনার দাদাকে নিয়ে নানা কটুক্তি সমাজে প্রচলিত আছে। কিন্তু আপনার পরদাদা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কোন কারণে আপনার দাদাকে নিয়ে বিতর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছে। এখন আপনার কাজ কি? আপনার দায়িত্ব হলো, নাতি হিসেবে ইতিহাসের এত তাহকীক করতে না গিয়ে আপনার দাদার ইজ্জত ও সম্মানকে সমুন্নত করতে যা যা করা যায় তার ব্যবস্থা করা। আপনাদের দলীয় অনেক নেতা-কর্মীদের মধ্যে উমাইয়া খিলাফত, হযরত আলী রা. মা আয়েশা রা. জঙ্গে সিফফীন, জঙ্গে জামাল ইত্যাদি বিষয়ে এমন কিছু বিষয় ইতিহাসের তাহকীকের নামে মাথায় ঢুকে গেছে যেগুলো নিয়ে আলেমদের মধ্যে গুঢ়তর আপত্তি আছে। রাসুল সা. এর ইন্তেকালের পরে ইসলামকে দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য ইসলামের শত্রুরা নানাভাবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করেছে। কখনো ইসলামের বেশ ধরে করেছে, কখনো মুনাফিকির চেহারা নিয়ে করেছে। সেই সময়ের সাহাবায়ে কেরাম কারো চেষ্টার মধ্যেই এটা নিয়ে কমতি ছিল না যে, কীভাবে রাসুল সা. এর আমানতকে রক্ষা করা যায়। এটাকে নির্ভুলভাবে রক্ষা করতে গিয়েই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে বিভিন্ন সময় উনাদের অনিচ্ছাতেই উনারা পরে গেছেন। এসব ইতিহাস নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এক একজন সাহাবীকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ঐতিহাসিকভাবেই ভুল। এছাড়া পবিত্র কুরআনের সুরা হাশর এর দশ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন :

وَالَّذِينَ جَاءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ (10)

অর্থ: যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু। (সুরা হাশর-১০)

অত্র আয়াত আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, আমরা আমাদের পুর্ববর্তীদের ব্যাপারে কোন ধরণের খারাপ ধারনা রাখবো না। ইতিহাসের তাহকীকের নামেও না। এতে আমাদের কোনই লাভ নেই। এসব ইতিহাস যদি জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে ত্যাগ করে তাহলে তাদের দলীয় কাজে কোনই ক্ষতি বয়ে আনবে না। ইতিহাসের এসব বিষয়গুলো কীভাবে শুধরে নেওয়া যায় তাও আপনারা আশাকরি ভাববেন। এতে দলীয় ইমেজ অনেক বৃদ্ধি পাবে।

০৫। তাফসীর এর ব্যাপারে সমাধানে আসা :

মাওলানা মওদুদী রহ. এর অনবদ্য রচনা তাফহীমুল কুরআন। অনেক কষ্ট করে তিনি দীর্ঘ এই তাফসীরটি রচনা করেছেন। ১৯খন্ডের এক বিশাল তাফসীর। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দলীয়ভাবে এই তাফসীরটি নানা সংযোজন ও বিয়োজন শেষে বর্তমানে বাজারে ছেড়েছে। এই তাফসীরের গোটা বিষয়গুলোই ভুল এমনটা কেউ বলে না। সামান্য কয়েকটি জায়গায় ব্যাখ্যা নিয়ে উলামাদের সাথে ভিন্নমত রয়েছে। মাওলানা মওদুদী রহ. তাঁর মতো করে এটা লিখে গিয়েছেন। এর দ্বারা আমাদের দেশের মানুষও উপকৃত হতে পারে। বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে যারা জড়িত শুধু তারাই এটা সংগহ করেন। পড়েন। কিন্তু আপনারা যদি একটু আন্তরিক হন, যদি একটু উদ্যোগ নেন, তাহলে এরদ্বারা সমগ্র জাতিই উপকৃত হতে পারে। আপনাদের আন্তরিকতা থাকলে এই তাফসীরটিকে শুধু দলীয় তাফসীর হিসেবে না রেখে সমগ্র দেশবাসির উপকারে এটাকে নিয়ে আসতে পারেন। এর জন্য সামান্য একটু উদ্যোগ প্রয়োজন। আপনাদের পক্ষ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল কর্তৃক এদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সাথে বসে যদি এভাবে প্রস্তাব করেন যে, আচ্ছা হুজুর, আপনারা উনিশজন আলেম দেন, যারা ভালো বাংলা পারে, তাফসীরেরও ভালো জ্ঞান রাখে, তারা মিলে ১৯খন্ড তাফসীর ১৯জনে মিলে একটা রিভিউ তৈরী করবে। যেখানে যেখানে ভাষাগত, ব্যাখ্যাগত ভিন্নমত থাকবে, সেগুলো নোট করে উভয়পক্ষের সম্পূর্ণ মতামতের ভিত্তিতে পরিমার্জিত একটি কপি প্রিন্ট করা হবে। যেটা সবার কাছেই গ্রহনযোগ্য হবে। এর মাধ্যমে আমি মনে করি সংকটের সমাধান করা সম্ভব। বিষয়টিতে আন্তরিক হতে হবে। শুধু লোক দেখানো উদ্যোগ নিলে কোন লাভ হবে না। আমি বিশ্বাস করি, আন্তরিক উদ্যোগ নিলে দুই পক্ষের মতামতের ভিত্তিতেই একটি সুন্দর সমাধান বের হয়ে আসবে। এতে হারজিতের কিছু নেই। সবার ইচ্ছায় যেহেতু: দ্বীনের খেদমত করা তাই এ কাজটা করা যেতে পারে।

০৬। পীর মাশায়েখদের ব্যাপারে সমাধানে আসা :

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে এদেশের পীর-মাশায়েখদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হযরত শাহজালাল রহ, খান জাহান আলী রহ, শাহ মাখদুম রহ. থেকে নিয়ে বাংলাদেশে শর্ষিণা, ফুরফুরা, জৈনপুরি, এদের কারো অবদানই কম নয়। পীর হিসেবে খ্যাত নূর কুতুবুল আলম রহ. এর অবদান বাঙ্গালী জাতি কোন দিনই ভুলতে পারবে না। ঢালাওভাবে পীর-মাশায়েখদের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এক ধরণের চরম নেতিবাচক মানসিকতা লালন করা হয়। আর এগুলো মূলত এসেছে মাওলানা মওদুদী রহ. এর নানা ব্যাখ্যা থেকে। হ্যাঁ, এটা অস্বীকার করছি না যে, এদেশে পীর-মাশায়েখদের নামে কেউ কেউ পেটপুঁজা করছে। নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। নানাভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছে। ধোকা দিচ্ছে। এটা এ কারণে নয় যে, এদেশের অনেক বড় আলেম যারা পীর হিসেবে সমাজে পরিচিত হয়েছেন তাদের কারণেই হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের মধ্যে ঢালাওভাবে এই মনোভাব লালন করা হয় যে, পীরমানেই ভন্ড, পীরের বুলি, পীর প্রথা মানেই ভন্ডামী। এতেকরে এদেশের কোটি কোটি পীর-মাশায়েখদের অনুসারীদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এটা এক ধরণের ধর্মীয় বিভাজন। এতে করে আমি মনে করি, জামায়াতে ইসলামীই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মূলত: বিশিষ্ট আলেমদেরকে উপমহাদেশের ভাষায় পীর হিসেবে অনেক জায়গায় আখ্যায়িত করা হয়। যেটা সৌদী আরবে শাঈখ হিসেবে পরিচিত। বিশিষ্ট শাঈখদেরকে মানুষ অন্ধভাবে অনুসরণ করে থাকে। জামায়াতে ইসলামীও তাদের দলীয় সমর্থক আলেমদেরকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে থাকে। এর অনেক নজির রয়েছে। সুতরাং এ বিষয়টাও কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যায় তার জন্য দলীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। সরাসরি কুফুরি এবং শিরকে লিপ্ত নয় এমন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, খানকাহ যারা পীর হিসেবে সমাজে পরিচিত তাদের সাথে দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। বায়তুশ শরফ এর পীর সাহেবকে কিন্তু জামায়াত যথাযথ মূল্যই দিয়ে থাকে। “পীর-আওলিয়ার বাংলাদেশ” এমন কবিতা ও গান মাঝে মাঝেই গাইতে শোনা যায়।

০৭। মুজাহিদদের ব্যাপারে সহনীয় মনোভাব প্রদর্শন :

বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রতিষ্ঠার নানামুখি মেহনত চলছে। জামায়াতে ইসলামী হয়তো একভাবে ইক্বামতে দ্বীনের কাজ নিয়ে ভাবে। অন্যরা হয়তো সেভাবে ভাবে না। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্নতোলা কষ্টকর। সারাবিশ্বেই একদল মুজাহিদ নিজেদের জীবন-যৌবন, পরিবার, সহায়-সম্পদ কোরবানী দিয়ে জিহাদের ময়দানে কাজ করে যাচ্ছে। এদের ব্যাপারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা-কর্মীর ঢালাও ধারণা খুবই খারাপ। তারা মনে করে- এসব সন্ত্রাসী কাজ। জঙ্গিবাদী কাজ। ইউরোপ-আমেরিকার ভাষায় অনেকেই কথা বলে। আমাদের অনেকেই আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্ভোগ নিয়ে নানাভাবে শঙ্কা প্রকাশ করি। কিন্তু সেখানে যখন হরকতুল জিহাদ কাজ শুরু করে সেটাকে সন্ত্রাসী কাজ মনে করি। কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য অনেক কষ্ট অনুভব করি। কিন্তু সেখানে যারা জালেম সরকারের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে যাচ্ছে তাদেরকে সন্ত্রাসী মনে করি। এভাবে আফগান, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় যারা সত্যিকার অর্থেই দ্বীনের বিজয়ের জন্য কাজ করছে তাদের ব্যাপারে খুবই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হয়। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, জিহাদের ময়দানে যারা কাজ করছে তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে হেয় করার জন্য পাশ্চাত্যশক্তি নানা ষড়যন্ত্র করে থাকে। তাই বলে গোটা মুজাহিদীনদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করা, নিজেদের কর্মপদ্ধতির সাথে তাদের কর্মপদ্ধতি না মিলার কারণে তাদেরকে অজ্ঞ, বোকা বলে ভাবাও উচিত নয়। এসব বিষয়ে যতদিন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম সহনশীল মনোভাব না দেখাবে ততদিন আলেমদের একটি অংশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মকেও সন্দেহের চোখে দেখবে। এই পরিবেশ দূর করতে হবে।

০৮। আলেম উলামাদেরকে আস্থায় নেওয়া :

ব্যাপক পরিসরে সফলতার জন্য এদেশের আলেম সমাজের সাথে দূরত্ব তৈরী করে দীর্ঘমেয়াদী সফলতা আশা করা যায় না।বিশেষভাবে কওমী ধারার আলেমদের কথাই বলবো। কারণ এদেশে কওমী ধারার আলেমদের একটি বড় ধরণের সামাজিক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে এদেশের এসব আলেমদের মতামতকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়াটা খুব সহজ বিষয় নয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে সফল হতে হলে এদেশের আলেমদের সাথে আচরণে উগ্রতা হ্রাস করতে হবে। আলেমগণ কোন বিষয়ে ভিন্নমত দেখালে এর সমাধান কোনপথে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে নেওয়া হতে পারে। আন্তরিকতা থাকলে এর সমাধান খুব বেশি কঠিন কিছু নয়। কিন্তু কৌশলের আশ্রয় নিলে সফলতা আশা করা যায় না। দ্বীন একটি বিশ্বাসের বিষয়। বিশ্বাসের জায়গায় যদি ঘাটতি থাকে তাহলে সফলতা আশা করা যায় না। অনেক লোককে দেখা যায়, আলেমদের সাথে ইচ্ছেকৃত প্রতারণা করেন। আলেমদের সরলতা নিয়ে অনেকে গেইম খেলেন। প্রকৃত আলেম যারা তারা সহজ-সরলই হয়ে থাকেন। আমরা যদি রাজা গণেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, গণেশের ছেলে যদুকে জালাল উদ্দীন বিশ্বাস নাম ধারণ করিয়ে তৎকালীন বিখ্যাত পীর নূর ‍কুতুবুল আলম রহ. যেভাবে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তা দেখলে বাহ্যিকভাবে একজন আধ্যাত্মিক নেতার কর্মকান্ডকে বোকামী্ই মনে হবে। অথচ পরবর্তীতে সেটাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য আলেমদের সাথে কোন প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া ঠিক হবে না।

০৯। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার না করা :

আমরা একটি বিষয় খুব লক্ষ্য করি যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর যারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধি, যারা জামায়াতের আদর্শ, নীতি, কর্মসূচীকে পছন্দ করে না, তাদের ব্যাপারে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। তাদেরকে ঘায়েল করার জন্য খুব নিম্নরুচির ভাষা ব্যবহার করা হয়। এটা সাংগঠনিকভাবে করা হয় না ঠিক। কিন্তু সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত নানা প্রান্তের লোকজন এটা করে। এবং উপর থেকে এসবকে নীরব সমর্থনও দেওয়া হয়। এভাবে তাদেরকে সঠিক পথে ফিরে আসার পথকে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে এক ধরণের হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তারা আরো বেশি জামায়াতের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। ইসলামকেই তারা একসময় চরমভাবে শত্রু হিসেবে ভাবতে থাকে।ফলে তারা তাদের সকল শক্তিকে এ কাজে ব্যয় করে। শাহবাগ আন্দোলন ছিল এমনই এক চরম প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আন্দোলন।

১০। ভিন্নমতের কাজের স্বীকৃৃৃৃতি দেওয়া :

কারো কাজকেই ছোট করে না দেখা। ইসলামের জন্য পৃথিবীর নানাপ্রান্তে নানা ছুঁরতে কাজ চলছে।বাংলাদেশেও ছোট-বড় অনেক দল, সংগঠন আন্তরিকতার সাথেই কাজ করছে এটা মানতে হবে। কেউ হয়তো বড় আকারে সফলতা পাচ্ছে। কেউ বড় ধরণের সফলতা পাচ্ছে না। কারো কাজের পদ্ধতিতে হয়তো ভুল আছে। কিন্তু আপনাদের বড় দল হিসেবে কাজ হবে সবার সাথে সত্যিকার অর্থেই আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করা। লোক দেখানো আন্তরিকতা নয়। অথবা সবাইকে নিজেদের দলে বিলুপ্ত করার কোন উদ্দেশ্যে নয়। এদেশে পীর-মাশায়েখরা দ্বীনের জন্য কাজ করছে। মসজিদ-মাদ্রাসা ভিত্তিক দ্বীনের কাজ হচ্ছে। দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে দ্বীনের কাজ হচ্ছে। পীরদের খানকাহ কেন্দ্রিক কাজ হচ্ছে। সব জায়গাতেই লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে। এমনকি কোটি মানুষও অনুসারী আছে। এসব ক্ষেত্রে কীভাবে সমন্বয় করে কাজ করা যায় তা শিখতে এরদোয়ানকে অনুসরণ করুন। এরদোয়ান সারাবিশ্বের যে কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও কথা বলছে। ইসলামের স্বার্থ আছে এমন যে কোন বিষয়ে তিনি কথা বলতে পিছপা হন না। তারা দেখে ইসলামের স্বার্থ। কিন্তু বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এমন একটি পরিবেশ তৈরী করতে পারেনি যে, তারা শুধু দ্বীনের স্বার্থেই কথা বলে।অনেকক্ষেত্রেই দলীয় স্বার্থ বিবেচনা করে কথা বলা হয়। এটা মনে করি ভুল পদ্ধতি। এদেশের উলামায়ে কেরাম যখন কোন বিষয়ে কথা বলেন, তখন আপনারা অনেক সময়ই নীরব থাকেন। দ্বীনের স্বার্থ নিয়ে যদি এদেশের মাজারপন্থীরাও কথা বলে, তাহলে তাদেরকেও সমর্থন দিয়ে কথা বলুন। ভিন্নমতের সব দল-মতের সবার ভালো কাজের প্রশংসা করতে শিখুন। ইনশাআল্লাহ সফলতা আপনাদের পদচুম্বন করবে।

উপরে যে কথাগুলো বললাম, আমার বিশ্বাস যে, এভাবে কাজ করে এগিয়ে গেলে আপনাদের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব।এতে আপনারাও উপৃকত হবেন। ইসলাম উপকৃত হবে। মুসলিমরা উপকৃত হবে। অন্যথায় বিশ্বাস হয় না কোনদিন ক্ষমতায় যেতে পারবেন। আর কোন সুযোগে ক্ষমতায় যেতে পারলেও রাবেয়া স্কয়ারের পরিণতিই হয়তো ভোগ করতে হবে।

লেখক : জেনারেল সেক্রেটারি,
বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট ( বিআইএম )

জাগো প্রহরী/এফ আর

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ