আইনুল হক কাসিমী ৷৷
● ১৩৪৮ খ্রিষ্টাব্দ। ৭৪৯ হিজরি।
মিসরে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি–কালোমৃত্যু। আরবিতে যাকে 'আল-মাওতুল আসওয়াদ, এবং ইংরেজিতে যাকে 'ব্ল্যাক ডেথ' বলা হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড়, ভয়ংকর ও মারাত্মক মহামারি ছিল। এই মহামারি প্রায় একলাখ মিসরি নাগরিকের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। কায়রোর মতো বড় শহরে রোজ একহাজার লোক মারা যেত!
● জনাকীর্ণ শহর কায়রো হয়ে পড়েছিল বিরান; তার রাস্তাঘাটে দৃষ্টিগোচরীভূত হতো না কোনো পথিক! কায়রোর দক্ষিণদিক 'বাবুয যাওয়িলাহ' থেকে যদি কোনো লোক হেঁটে যেত কায়রোর উত্তরদিক 'বাবুন নাসির'র দিকে, তাহলে পুরো রাস্তায় কাউকে নজরে পড়ত না। সবই গিয়েছিল মরে। আর যারা ছিল বেঁচে, তারাও ব্যস্ত ছিল লাশের পর লাশের দাফন-কাফনে। কায়রোর রাস্তাঘাটে ধূলোবালু জমা হয়ে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, বুঝা যেত–এটি কোনো মানবের শহর নয়; অশরীরী আত্মার বসবাসের শহর!
● মানুষের চেহারা হয়ে গিয়েছিল বিবর্ণ। ঘরে ঘরে ছিল কান্নার রোল। কোনো ঘরের পাশ দিয়ে গেলেই শোনা যেত বুক চাপড়ানো মাতম। কোনো গলি দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ত লাশ আর লাশ। একটি খাটিয়া আরেকটি খাটির সাথে এতোই লাগোয়া ছিল যে, দেখতে মনে হতো লাশের মিছিল! একই কবরে দাফন করতে হতো কয়েকটি লাশ। কোনো কোনো ঘরের সব লোক মরে সাফ হয়ে যেত। আসবাবপত্র পড়ে রইত। ছুঁয়ে ধরার মতোও ছিল না কেউ।
● মৃত লোকের কেউ উত্তরাধিকারী হলে, সে উত্তরাধিকার বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না; একটু পরেই তা স্থানান্তরিত হয়ে যেত। এমনকী একই দিনে চার-পাঁচজনের হাতে স্থানান্তরিত হতো! চেইনের মতো একের পর এক সব উত্তরাধিকারী মারা পড়ত বলে। কাজি বা শরিয়া বিচারপতির জন্যও সম্ভবপর ছিল না এই উত্তরাধিকার বণ্টন করা। কারণ, তিনি কাকে দেবেন? উত্তরাধিকারীদের কেউ বেঁচে থাকলে না হয়! শেষপর্যন্ত তিনি এই সম্পদ বাইতুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অন্তর্ভুক্ত করে দিতেন। এমন দুঃসময়ে মিসরে একটা প্রবাদবাক্য মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল–হে উত্তরাধিকারী! তোমার উত্তরাধিকারী হবে কে?
● বিপদ যখন আর কাটছিল না; বাড়ছিল শুধু শনৈ: শনৈ:, তখন মিসরের মসজিদে মসজিদে উলামা ও বুজুর্গানে দীন লোকদেরকে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও ফরিয়াদ করার ওয়াজ করতে লাগলেন। পাশাপাশি মজলুমের হক ফিরিয়ে দিতে, ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করতে, মানবতা জাগিয়ে তুলতে; সর্বোপরি দুনিয়াবিমুখ হয়ে বেশি বেশি করে আল্লাহমুখি নসিহত করতে লাগলেন। মৃত্যুতাড়িত লোকগুলো বুজুর্গদের নসিহতকে নিয়েছিল মাথা পেতে।
● আশ্চর্যকথা হলেও সত্য যে, কিছুদিন যেতে না যেতেই মিসর থেকে কালোমৃত্যুর গজব দূরীভূত হতে শুরু করল। আর দূরীভূত হবেই বা না কেন? আল্লাহ তাআলা তো পবিত্র কুরআনের সুরা আনআমের ৪৩ নং আয়াতে বলে দিয়েছেন :
فَلَوْلَا إِذْ جَاءَهُم بَأْسُنَا تَضَرَّعُوا وَلَٰكِن قَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
অতঃপর যখন তাদের কাছে আমার আজাব এলো, তখন কেন তারা কাকুতি-মিনতি করল না ? বস্তুত : তাদের অন্তর কঠোর হয়ে গিয়েছে এবং শয়তান তাদের কাছে সুশোভিত করে দেখিয়েছে তারা যা করত, তাকে।
জাগো প্রহরী/এফ আর
0 মন্তব্যসমূহ