রাষ্ট্র ও হেফাজত : আলোর আঁধারযাত্রা



নোমান বিন আরমান ৷৷

# রাষ্ট্র : জনপ্রত্যাশা
জাতীয় চেতনা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ-বিশ্বাসের লালন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের কাছে গণমানুষের প্রত্যাশার বড় জায়গাটি এখানেই। এটা সংরক্ষণ, লালন ও বিকাশে রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার যদি তা করতে অসমর্থ হয়, অবহেলা করে বা চাতুর্যের আশ্রয় নেয়; তাহলে সে সরকারকে গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করার নৈতিক মানে উত্তীর্ণ বলা যায় না। এ বিবেচনায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করলে গণমানুষের বোধ ও বিশ্বাসকে উপেক্ষার বেশ কিছু দলিল সামনে হাজির হয়।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আটচল্লিশ বছর পার করছে। বিশাল প্রত্যাশা কাঁধে করে বছর বছর রাষ্ট্রের বয়স বাড়লেও প্রাপ্তি কখনোই সন্তোষজনক হয়নি। এদেশের মানুষ তাদের বোধ ও বিশ্বাসের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে রাষ্ট্রকে পাশে পায়নি। রাষ্ট্র যদি মানুষের জন্য হয়, তাহলে জনতার প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা তার কর্তব্য। এই কর্তব্যপালনকে সে অবজ্ঞা করতে পারে না। পারে না বিশেষগোষ্ঠির চাপে রাষ্ট্রক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে। কিন্তু বরাবরই সেটা হতে আমরা দেখেছি। গোষ্ঠিবিশেষের স্বার্থরক্ষার ‘গণতান্ত্রিক’ রূপটি প্রতিবারই প্রকাশ্যে এসেছে নগ্নভাবে। সিংহভাগ মানুষের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বারেবারে। এভাবেই প্রতিটি সরকার জনপ্রত্যাশার প্রাণবীজকে নির্বিবেচনায় হত্যা করেছে।

# চিন্তার ঐক্য : বিভাজননীতি
আটচল্লিশ বছরেও দেশে জাতীয় ঐক্য চিন্তার প্লাটফর্ম তৈরি হয়নি। সমন্বয় করা যায়নি নাগরিকদের ভিন্নমত ও ভাবনার। প্রত্যেক পক্ষই চাইছে, নিজেদের মতাদর্শ ও বোধ-বিশ্বাস অন্য সবার ওপর চাপিয়ে দিতে। অথবা অন্যের মতাদর্শকে খাটো ও বিদ্রুপ করতে। 
দুঃখজনক হলো, রাষ্ট্রপরিচালনাকারীরাও এ বিভাজননীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এখনও করছে। অনেক সময় দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যও তারা এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এর সঙ্গে রয়েছে, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণকারী সাম্রাজ্যবাদী ও পুজীবাদী রাষ্ট্রসমূহের কথিত ‘ওয়ার অন টেরর’ নীতি। এই নীতিতে এসব দেশকে নিজেদের পছন্দসই চলতে প্ররোচিত এবং ক্ষেত্রবিশেষ বাধ্য করে তারা। তাদের পলিসি বাস্তবায়নে নিরন্তর যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তারা এ যুদ্ধের প্রধান প্রতিপক্ষ করেছে ইসলামকে। এ জন্যে সারাবিশ্বে ইসলামোফোবিয়া তৈরির সব ধরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ মিশন সফল করতে মুসলিম দেশগুলোতে নানাভাবে কাজ চলছে। তারা নিজেরা যেমন কাজ করছে, কাজ করাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের দিয়েও। সেসব ‘নাগরিক’ পশ্চিমাদের সুরে ভেবে তৃপ্তি লাভ করেন। তাদের চোখে দেখে সুখবোধ করেন। এর জন্য সিংহভাগ মানুষের বোধ ও বিশ্বাসকে দলিত করতেও তারা মোটেই কুণ্ঠিত হন না।

# দু’ হাজার তোরো : রাজনীতিতে ‘পলিটিক্স’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচে নাটকীয় বছর হলো দু’হাজার তেরো। ওই বছর দেশের রাজনীতির গলি-গুপচিতে রহস্যময় ‘পলিটিক্স’ ঢোকে পড়ে। রহস্যময় কারণ, কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে, কোনখানের মাছ কোথায় লাফ দিচ্ছে— এসব সাধারণের চোখ ও বোধে সহজবোধ্য ছিল না। এই পলিটিক্সের কুশীলবরা ছিলেন গভীর জলের হাঙর। সাধারণ জেলেদের পক্ষে তাদের ধরবার জো ছিল না। অনেক বড় জেলেদের নাগালেরও বাইরে ছিলেন তারা। তাদের ব্যপ্তি ছিল দেশ-দেশান্তরে। হাত ছিলো এমন দীর্ঘ— অনায়াশে ছুঁয়েছে সীমান্তের পর সীমান্ত। ফলে এমন অনেকে কিছুই তখন হয়েছে, যা অনেকের ‘মাথার উপর’ দিয়ে গেছে।
এই কুশীলবরা প্রথমে আসর বসিয়েছিলেন রাজধানীর শাহবাগে। এর পোশাকি নাম দিয়েছিলেন গণজাগরণমঞ্চ। এই মঞ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জমায়েত শুরু করে। যুদ্ধাপরাধে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দণ্ডের পরিবর্তে ‘ফাঁসি’র দাবিই ছিল তাদের মঞ্চ গড়ার প্রথম কারণ। কিন্তু খুব দ্রুতই মঞ্চের স্ক্রিপ্ট বদলে যেতে থাকে। ফাঁসির দাবির সঙ্গে গণমানুষের বোধ-বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির শেকড় ধরে টান দেবার কসরত চলে। সেখানে এমনসব মুখকে প্রতিনিধিত্বের আকর করা হয়, যাদের ‘পেশাই’ হল ধর্মবিরোধিতা। শুধু বিরোধিতা হলেও কিছুটা গা সওয়া হতো ব্যাপারটা— তারা ছিল আদতে ধর্মবিদ্বেষী। তাদের অন্তরের সবটুকু বিষবিদ্বেষ বরাদ্দ শুধু ইসলামের বিরোধিতায়। শাহবাগের জোয়ারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা ইসলামকে বানের পানিতে খরকুটোর মতো ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলো। ভেবেছিল তাদের আওয়াজেই বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাস তৈরি হবে— মুহূর্তে উড়ে যাবে তাবত ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। সন্দেহ নেই, গণজাগরণমঞ্চের প্রথম সপ্তাহ কিন্তু এমন জলোচ্ছ্বাসের কালো ছায়ায় ঢাকা ছিল, দেশ— গোটা বাংলাদেশ।

# রায়বিরোধী অবস্থান : ত্রাতা তিনি
আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান হওয়ার পরও খোদ প্রধানমন্ত্রী শাহবাগের মাথায় ভরসার ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। সংসদে দাঁড়িয়ে শাহবাগকে স্বাগত জানান। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি দিয়ে শাহবাগের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থানের জানান দেন। এতে খুটির জোর বেড়ে যায় তাদের। প্রিন্ট, অনলাইন ও টিভি চ্যানেল— সবখানে শুরু থেকেই চলছিল কুশীলবদের বাঁধা ছকে তীব্র শাহবাগ বন্দনা। গণমাধ্যমে অন্যসব কণ্ঠ ও কণ্ঠস্বর তখন ঝড়ের কবলে পড়া বকের মতো বিধ্বস্ত। বিপর্যস্ত। এমন একটা আবহ তৈরি করা হয়েছিল— শাহবাগই যেন দেশ। শাহবাগই যেন রাষ্ট্র! এর বাইরে কোনো আওয়াজ নেই। কণ্ঠস্বর নেই। সবখানেই ধোয়াশা। কারও কাছেই কোনো কিছু তেমন পরিস্কার না। এখনের চে’ বিএনপির অবস্থা তখন অনেকটাই ভালও। এরপরও শাহবাগ নিয়ে দলটির দ্বিধা সবার দৃষ্টি কাড়ে। পক্ষে না বিপক্ষে বলবেন, তা ভাবতে সময় নেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। অন্য দল, বিশেষত ইসলামপন্থিদের অবস্থা তখন— নিদারুণ করুণ। সবার যেন মুখ লোকাবার একটা প্রচেষ্টা। রাস্তায় বেরোলে কেউ দেখে ফেলে কি না এমন শঙ্কায় পথ চলেন ‘রাজপথ কাঁপানো’, ‘বাতিলের আতঙ্ক’ হিসেবে খ্যাত হুজুর নেতারা।

# দুঃস্বপ্নের সময় : একটি খোলা চিঠি
এরকম এক দুঃস্বপ্নের সময়েই একটি খোলা চিঠি ছাপা হয় অধুনালুপ্ত আমার দেশসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে। চিঠিটি হেফাজতে ইসলামের। সেই চিঠিই ছিল এক চেটিয়া শাহবাগ বন্দনার মিছিলে ভিন্ন সুর। নতুন কণ্ঠস্বর। শাহবাগের ইসলাম বিদ্বেষের প্রতিবাদে উচ্চকিত হেফাজতের সেই চিঠি। রাজনীতির দাবাখেলায় শাহবাগের বিপরীতে উদয় হয় নতুন কুশীলবদের। ভিন্ন লড়াইর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তবে এতে দেশের সাধারণ মানুষ, ধর্মবিশ্বাসী জনতা শ্বাস নেবার ফুসরত পান। বুকে বল ফিরে আসে ‘রাজপথ কাঁপানো’ নেতাদের।
হেফাজতের সেই খোলা চিঠিই প্রাণস্পন্দ ফিরিয়ে দিয়েছিল ইসলামি দলগুলোর নেতাদের। কথা বলার প্লট পেয়েছিলেন তারা। গণমাধ্যমেরও একমুখী প্রচরণা তখন ঝাঁকুনি খায়। সম্বিৎ ফিরে তাদের। টিভি টকশোতে আমন্ত্রিত হতে থাকেন আলেম নেতারা। প্রথমবারের মত মিডিয়ার মনোযোগের কেন্দ্রে আসেন তারা। 
হেফাজত মাঠে আসার পর শাহবাগের মেলা বদলে যেতে থাকে। যেখান থেকে উচ্চকণ্ঠে ইসলামবিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হয়েছিল, সেখানেই নতুন সুর বাজতে থাকে।

# শাহবাগ : ভূতের মুখে খোদার নাম
এদেশের অনেক মানুষ ব্যবহারিক জীবনে ধর্মকর্মের তেমন ধার ধারে না। কিন্তু মনোজগতে প্রত্যেকেই ধার্মিক। সারাজীবন বাউন্ডুলেপনা করে ঘুরে বেড়াতে পারে। জীবনে একবারও মসজিদে না যেতে পারে। কিন্তু এটা কখনও বলবে না, আমার জানাজা পড়ো না, কবর দিও না। এ কারণেই জীবনভর বিরোধিতা করেও এ দেশের প্রগতিশীলদের গুরুরা পর্যন্ত জানাজা নিয়েছেন, কবরেও শুয়েছেন। খোদ শাহবাগেও ঘটে একই কাণ্ড। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত ‘ব্লগার’ রাজিব হায়দার নিহত হলে তারও জানাজা হয়। এতে অংশ নেন শাহবাগে উপস্থিত সকলে। যারা নাস্তিকের ‘আভিজাত্য’ গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান, তারাও শরিক হন ধর্মীয় আচার পালনে। শাহবাগের ‘ননস্টপ’ স্লোগানে বিরতি দেয়া হয় আজানের। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু করা হয় অনুষ্ঠান। তবে তাদের এই হঠাৎ ধর্ম পালন গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এটা যে ফান্দে পড়ে কান্দন— তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। নাস্তিক ট্যাগ খাওয়া থেকে মুক্তি পেতেই যে লোক দেখানো ধর্মপালন— এটা বুঝেন সকলেই।

# ছক বদল : বিরিয়ানি থেকে দৌড়ানি
শাহবাগ শুধু আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল— এমন নয়। তারা গোটা দেশের জনশক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। জামায়াতবিরোধিতার ছলে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে মুহুর্মুহু শ্লোগান তুলে। সমান তালে চলে বাদ্য। কিন্তু শ্লোগান ও বাদ্য দিয়ে কার্যসিদ্ধিতে সফল হতে পারেনি তারা। নাস্তিক বিতর্কে জনমন তাদের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়। দিনে দিনে ম্লান হতে থাকে শাহবাগ। কমতে থাকে জনবল। এমন প্রেক্ষিতেই সেখানে রক্তঝরে। আবার পাল্টায় দৃশ্যপট। কিন্তু রক্ত ঝরিয়েও শাহবাগ আগের সেই ইমেজে ফিরতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যেই বিভেদ তৈরি হয়। ভাগ হয়ে যায় শাহবাগ। ছক বদল করেন কুশীলবরা। ক্ষমতাসীনদের প্রিয়পাত্র থেকে রোষের পাত্রে পরিণত হন গণজাগরণের মুখপাত্র ডা. ইমরান সরকার। বিরিয়ানির প্যাকেট থেকে দৌড়ানি জুটে ইমরানদের কপালে।

# দৃশ্যে হেফাজত : সফেদ টুপি রক্তে লাল 
শাহবাগের ইমেজ কমলেও একই সময়ে জোয়ার বইছিল হেফাজতের জনপ্রিয়তার। ৫ এপ্রিল হেফাজত যখন ঢাকায় সমাবেশ করছে, সেসময় শাহবাগকে ভেজা কাকের মতো ম্রিয়মাণ মনে হয়েছিল। মতিঝিল, দৈনিক বাংলা মোড়, পল্টন, বায়তুল মুকাররামসহ ঢাকার অলিগলিতে সফেদ টুপি আর পাঞ্জাবির উৎসব। এই উৎসবের মধ্যে তৈরি হয়েছিল নতুন স্বপ্ন আর সম্ভাবনার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর সম্ভাবনা, সেই সফেদ টুপির উৎসব— ঠিক এক মাসের মাথায় রক্তে ভেসে যায়। একই শাপলায় ৫ ও ৬ মে ডুবে যায় সম্ভাবনার সোনালি সূর্য। নিরস্ত্র, বিপন্ন, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ও নেতৃত্বশূন্য শাপলায় নামে ভয়াভবহ তাণ্ডব।

# ওই হেফাজত : সেই হেফাজত
২০১৩ সালে যে হেফাজতের উত্থান, প্রতিষ্ঠাকালিন হেফাজতের সঙ্গে রয়েছে তার বিস্তর ব্যবধান। তবে তা আদর্শিক নয়, কর্মসূচিক। ২০১০ এ জন্ম নেওয়া ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামের এ সংগঠনটির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিলো চট্টগ্রামেই। সংগঠনটি নিজেদের ‘সাধ্যের’ ভেতরে থেকেই ‘ঈমানি’ দায়িত্ব পালন করেছে। যেমনটা দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘তৌহিদি জনতা’ করে থাকেন। সেসব যেমন সাধারণত নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তেমনিই হয়তো আজীবন থাকতো হেফাজত। তারা হয়তো কখনোই ঢাকায় লংমার্চে আসতো না। অবরোধ করতো না। এর পূর্বে বৃহৎ ও বৃহত্তর জাতীয় কর্মসূচি পালনের নজিরও তাদের নেই। তাহলে, চট্টগ্রাম থেকে হেফাজতকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করার পথ করে দিলো কারা? কারা বৃহৎ শক্তিতে পরিণত করলো হেফাজতকে? ‘সামাজিক সংস্থা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সংগঠনটি গণসংগঠন থেকেও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল কেন?

# শাপলার মঞ্চ : নিরব কণ্ঠস্বর
যেকোনো আন্দোলনেই মূল ব্যক্তির বক্তব্য সঞ্জিবনী শক্তির কাজ করে। মূল নেতার বক্তব্য ছাড়া কোনো আন্দোলন স্থিতি পায় না। পৃথিবীর সবগুলো গণআন্দোলনকে যদি দেখা হয়, তাহলে সেখানে মূল নেতার কণ্ঠস্বরই প্রতিভাত হবে। বিশ্ববিখ্যাত নেতাদের এমন অসংখ্য ভাষণ নজির হয়ে আছে। খোদ নবিজী সা.’র জীবন থেকেও এর দৃষ্টান্ত নেওয়া যায়। বিদায় হজের ভাষণ তো ঐতিহাসিক দলিল। 

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ এখনও শিহরণ জাগায়। রক্তে আগুন ধরায়। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে বারুদ। কবিতার মত শোনায় তাঁর পুরো ভাষণ। কী ত্যাজ তার কণ্ঠে। একজন নেতার স্বর যেমন হওয়ার, তার চে’ অনেক দীপ্ত ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠস্বর এখনও স্পন্দিত করে কোটি প্রাণকে। হেফাজত যখন লংমার্চে আসে, শাপলায় সমাবেশ করে। তখন বেশ সময় মঞ্চে বসা ছিলেন সংগঠনটির আমির আল্লামা আহমদ শফি। কিন্তু তিনি কোনো বক্তৃতা করেননি। পুরোটা সময় তিনি ছিলেন নিরব। শুধু মুনাজত করেছিলেন। দ্বিতীয়বার অবরোধে, তিনি মঞ্চেই আসতে পারেনি। আসেননি। ফলে এমন একটা গণজাগরণী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও, সেখানে নেতা হিসেবে তাঁর কোনো বক্তব্যের রেকর্ড নেই। জাতির জন্য কোনো নির্দেশনা নেই। অথচ এমনক্ষেত্রে মূল নেতার ভাষণই আন্দোলনের ঐতহাসিক দলিল হয়ে থাকে।

# শকুনের তসবিহ : নেতাদের ভীমরতি
প্রথমবার লংমার্চ করে বীরের বেশে বাড়ি ফেরে হেফাজত। কিন্তু দ্বিতীয়বার ঢাকা আসার ঘোষণায় অস্বস্তি তৈরি হয় ক্ষমতাসীন শিবিরে। নতুন হিসেব শুরু হয় বিরোধীজোটে। হেফাজতের ফিরে আসাকে সরকার মসনদের খতরা হিসেবে দেখে। লংমার্চে অভূতপূর্ব সাড়ায় বিরোধীরা আটঘাঁট বেঁধে বসেন। তাদের অনেকের হাতে শকুনের তসবিহ। কোনোভাবে গরুটা মারা গেলে, লুটে নেওয়ার তোড়জোর তাদের। এই তোড়জোরে হেফাজতের কিছু নেতাদের মধ্যেও ভীমরতি দেখা দেয়ায়। কেউ কেউ মসনদের খোয়াবে বুঁদ হয়ে যান। কাণ্ডজ্ঞান হারান। তেজারতি করেন।

৫ মে শাপলায় ‘অবস্থান ও অবরোধ’ নিয়ে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ও সমন্বয় ছিল খুবই অস্পষ্ট ও ধোয়াশায় ঢাকা। পুরোদিন যেখানে নিরস্ত্র, বিপন্ন, ক্লান্ত ছাত্র-জনতার ওপর তাণ্ডব চলেছে। বর্বর হামলা করেছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শাহবাগীরা। কয়েক স্থানে হতাহতের খবরও এসেছে। তখন সেখানে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত কি সুবিবেচনা ছিল? সারাদিন যেখানে তাণ্ডব চলেছে, রাতের আঁধারে ছাত্র-জনতা যে সেখানে হিংস্র হায়েনার খাদ্যে পরিণত হবে— এটা অনুধান করার পরিণতবোধ কি কোথাও জাগ্রত হয়নি? নুন্যতম নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা না রেখে অবস্থানের সিদ্ধান্ত কি আত্মঘাতী ছিল না? কারা নিয়েছিলেন সেই সিদ্ধান্ত? সরকারি বাহিনির লাখো বারুদ-বুলেট যখন ছুটে এসেছিল— কোথায় ছিলেন তারা?

# নামে থ্রিলার : আদতে ওয়ার
অপারেশান ফ্লাশ আউট, অপারেশন সিকিউরড শাপলা ও অপারেশন ক্যাপচার শাপলা। শুনতে থ্রিলার বইয়ের নাম লাগছে না? আমারও লাগছে। থ্রিলারের নাম হলেই স্বস্তি পেতাম। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো ছিল রীতিমত সামরিক কায়দার ওয়ারের নাম। সামরিক কায়দার এই যুদ্ধ ছিল বেসামরিক ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে। শাপলায় আশ্রয় ও অবস্থান নেওয়া নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে ‘উচ্ছেদ’ করতে যৌথবাহিনীর অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশান ফ্লাশ আউট’। পুলিশের অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’। বিজিবি নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’। গণমাধ্যমের হিসেবে যৌথবাহিনির এই অভিযানে দেড় লক্ষাধিক বারুদ ব্যবহার করা হয়েছিল।

# ক্ষয় আছে : খতিয়ান নেই
দাগ-খতিয়ান বাংলায় খুব পরিচিত শব্দ। জমিজামার স্বত্ব পেতে এই দাগ-খতিয়ান লাগবেই। দাগ-খতিয়ান ঠিক না থাকলে জমির মালিকানা থাকবে না। স্বত্বও দাবি করা যাবে না। শাপলায় হেফাজতের রক্ত ঝরেছিল, খুন হয়েছিল ছাত্রজনতা। কিন্তু হেফাজতের কাছে এসবের দাগ-খতিয়ান নেই। দলিল-দস্তাবেজ নেই। ফলে, হেফাজতিরা সেখানে রঙ মেখে শুয়েছিল—সেটাই প্রচার পায়। তা নিরবে কান পেতে শুনে হেফাজত। তাঁর রক্ত তখনও কথা বলেনি। এরপর? এরপর শোকরিয়া জানাতে গেলে— সেখানে সরকারি তরফে বলে দেওয়া হলো— শাপলায় কোনো রক্ত ঝরেনি। কেউ খুন হয়নি। দুই কান ভরে মঞ্চে বসে সেই বক্তব্যও গিললেন নেতারা। কেউ টু-শব্দটি করেননি। কীভাবেই বা করবেন, কারও রক্ত ঝরেছিল, কেউ খুন হয়েছিল এমন কোনো হিসেব তো তাদের কাছে নেই। খুনের দাগ-খতিয়ান তারা রাখেননি। রাখার দরকারও মনে করেন না।

# হেফাজতে ইসলাম : হেফাজতে সরকার
২০১৩ থেকে ২০১৯। বছরের সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছু। বিস্মৃতির ধুলো জমেছে স্মৃতিতে। শুকিয়ে গেছে ক্ষতের দাগ। এখন ক্ষোভের উনুনে তৈরি হচ্ছে ‘কৃতজ্ঞতা’র স্যুপ। যে শাহবাগ ছিল সরকারের প্রমোদবালক, তারা হয়েছে চোখের ছাই। হেফাজত হয়েছে সরকারের নতুন সহচর। হেফাজতে ইসলাম এখন প্রকারান্তরে সরকারের হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছে। সরকারি ছকে হাঁটছে। সরকারি ‘হাজিসাব’ হচ্ছে। ‘গোপন’ দাবি-দাওয়া আদায় হচ্ছে। এসব জোর গলায় বলেও বেড়াচ্ছেন সরকারে হুজুর নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রী। আলেমদের কৃতজ্ঞ রাখতে নানা ধরণের প্যাকেজ ফর্মূলা তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্র ও সিস্টেমের কৃতজ্ঞতা প্যাকেজের আওয়াত থাকা কোনো জাতি গোষ্ঠি কখনো সিস্টেমের গলদ দেখতে পায় না। দেখলেও কথা বলার মুরোদ থাকে না। দিয়ে ধন্য, পেয়ে কৃতজ্ঞ থাকার যে তালিম চলছে— এর ক্ষত অনেক বেশি গভীর হবে। সেই ক্ষত সেরে তুলবার জন্য হয়তো নতুন কোনো হেফাজত আসবে। নতুন কাণ্ডারি জাগবে। কিন্তু এই হেফাজতকে দিয়ে আর হবে না। আলোর এখন আঁধারযাত্রার কাল বইছে।
-১ ডিসেম্বর ২০১৯

জাগো প্রহরী/গালিব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ